ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট অমৃতা মিশ্র, পারমিতা ভট্টাচার্য, সঞ্চারী ভট্টাচার্য এবং রিমা সাউ। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
সকাল তখন ৮ টা। বোলপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণির দুই ছাত্রী আপন মনেই সাইকেল চালিয়ে টিউশন পড়তে যাচ্ছিল। মাসটা ছিল অগস্ট মাস। দুই বান্ধবীর একজনের বাড়ি গোয়ালপাড়া অন্যজনের বাড়ি বোলপুরের প্রান্তিকে। প্রান্তিক স্টেশন পেরিয়ে মূল রাস্তায় উঠে নবনির্মিত ব্রিজ পেরোতেই কম জনবসতিপূর্ণ এলাকা। সেখানে ঢুকতেই হঠাৎ তাদের পিছু নেয় মোটরবাইক আরোহী এক যুবক। পিছন থেকে আসতে থাকে বিভিন্ন রকম কু কথা, সেই কথায় কান না দিয়েই দুই বান্ধবী সাইকেলের গতি বাড়াতে থাকে, এরপরেই মোটরবাইক আরোহী তার গতি বাড়িয়ে ওই দুই ছাত্রীর একজনের হাত ধরে টানার চেষ্টা করে, অন্য বান্ধবী পারমিতা ভট্টাচার্যের সেই সময়ে মনে হয়েছিল যে করেই হোক এই যুবকের হাত থেকে বান্ধবীকে বাঁচাতেই হবে। তখনই তার মনে পড়ে গোয়ালপাড়া স্কুলে ক্যারাটে প্রশিক্ষক কৌশভ সান্যালের কথা।
ক্যারাটের শিক্ষক তাদের শিখিয়েছিলেন কীভাবে আত্মরক্ষা করতে হয়, কীভাবে সুযোগ সন্ধানীকে শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায় আঘাত করে ঘায়েল করতে হয়। পাঁচ বছর ধরে এই প্রশিক্ষণই নিয়ে আসছে পারমিতা। এক্ষেত্রেও ভয় না পেয়ে, ঘাবড়ে না গিয়ে, উপস্থিত বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে ইভটিজারের তলপেটে মোক্ষম দু’টো পাঞ্চ চালায় পারমিতা। রাস্তাতেই ধরাশায়ী হয়ে পড়ে ওই বাইকআরোহী। পারমিতার সাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় তখনই।
পারমিতার এই সাহসিকতার প্রশংসা করেছিল জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং বোলপুরবাসীরা। একদিন যাঁরা বলেছিলেন গ্রামের মেয়ে ক্যারাটে শিখে কী করবে এই ঘটনা সেই সমালোচকদেরও যোগ্য জবাব দেয়। পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে অভিবাবকদের একাংশের মতে এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মেয়েদের আত্মরক্ষায় ক্যারাটে শিক্ষা কত জরুরি।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
জেলার নানা প্রান্তে কখনও ছাত্রীর শ্লীলতাহানি তো কখনও ইভটিজারদের পাল্লায় পরতে হয় ছাত্রীদের। অনেকেরই সাহসে কুলায় না, তাই প্রতিবাদ করতে পারে না তারা। আর প্রতিবাদ না করায় দিন দিন ছাত্রীর শ্লীলতাহানি, ছিনতাই, ইভটিজারদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। অভিভাবকদের একাংশের দাবি, ইভটিজারদের যোগ্য জবাব দিতে ঘরে ঘরে তৈরি হোক পারমিতার মতো প্রতিবাদী সাহসিনী।
আত্মরক্ষার স্বার্থে বর্তমানে বেশিরভাগ মেয়েরাই ক্যারাটে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। শুধু প্রশিক্ষণই নয়, প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা দক্ষতার পরিচয় দিয়ে পাড়ি দিচ্ছেন এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে। বোলপুরের এমনই চার মেয়ে হয়ে উঠেছেন বোলপুরবাসীর কাছে গর্বের। গোয়ালপাড়ার বাসিন্দা পারমিতা ভট্টাচার্য পাঁচ বছর ধরে ক্যারাটে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। গত বছর মণিপুরে জাতীয় ক্যারাটে চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় সোনার পদক নিয়ে এসেছে সে। ওই আসরে সারা দেশের ২০টি রাজ্য থেকে প্রায় ১৭০ জন প্রতিযোগী অংশ নেয়। সেখানে সকলের নজর কেড়েছিল পারমিতা। গুয়াহাটিতে রাজ্য চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় কুমিতে রূপোর পদকও নিয়ে এসেছে।
সোনাঝুরির বাসিন্দা বি এ প্রথম বর্ষের ছাত্রী অমৃতা মিশ্র চার বছর ধরে ক্যারাটের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। সে রাজ্যস্তরে চারটি সোনার পদক, একটি রূপোর পদক লাভ করেছে। বোলপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী সঞ্চারী ভট্টাচার্যও চার বছর ধরে ক্যারাটে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। সে রাজ্যস্তরে ক্যারাটে প্রতিযোগিতায় রূপো এবং ব্রোঞ্জ পদক নিয়ে এসেছে গত বছরে। গোয়ালপাড়ার বাসিন্দা প্রথম বর্ষের ছাত্রী রিমা সাউ ক্যারাটেতে যথেষ্ট পারদর্শী হয়ে উঠেছে। রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় সোনার পদক, রূপোর পদক রয়েছে তার ঝুলিতেও। এই চারজনই বর্তমানে ক্যারাটে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে কৌশভ সান্যালের কাছে।
ক্যারাটে প্রশিক্ষক কৌশভ সান্যাল বলেন, ‘‘মেয়েদের আত্মরক্ষার অন্যতম শিক্ষা হলো ক্যারাটে প্রশিক্ষণ। আজকাল সমাজের নানা প্রান্তে মেয়েরা বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়, প্রতিটা মেয়েরই আত্মরক্ষার কৌশল জানা থাকা জরুরি। ক্যারাটে জানলে মেয়েদের মনোবল অনেকটাই বেড়ে যায়।’’
চলতি বছরের জুলাই মাসে এই চারজন নেপালে আন্তর্জাতিক ক্যারাটে চ্যাম্পিয়নশিপের আসরে এবং সেপ্টেম্বরে রাশিয়ায় আন্তর্জাতিক ক্যারাটে চ্যাম্পিয়নশিপের আসরে যোগ দিতে চলেছে। প্রথমবার আন্তর্জাতিক স্তরের কোনও প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে জেলার এই চার কন্যা। প্রত্যেকেই সেখানে ভাল ফলের স্বপ্ন দেখছে। তাদের আশা ওই দুই জায়গা থেকেই পদক নিয়ে আসবে তারা। স্বর্ণপদকই তাদের কাছে এখন পাখির চোখ।
তবে প্রতিকূলতাও রয়েছে অনেক। এদের মধ্যে প্রায় সকলেরই আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। পারমিতার বাবা-মা বাড়িতে রান্না করে লোকের বাড়ি খাবার পৌছে দেন। যৎসামান্য সেই উপার্জনেই চলে তাঁদের সংসার। তার মধ্যে মেয়ের পড়াশোনা থাকে খেলার খরচ সবটাই হাসিমুখে চালান তাঁরা। পারমিতাই তাঁদের স্বপ্ন। পারমিতার মা মধুমিতা ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘মেয়ের বহু জায়গায় খেলার সুযোগ আসে কিন্তু অর্থের অভাবে সব জায়গায় পাঠাতে পারি না। যাতায়াতের খরচ রয়েছে। সেখানে থাকা-খাওয়ারও বন্দোবস্ত করতে হয়। যেখানে সবরকম সুযোগ সুবিধা দেয় সেখানেই খেলতে যায় ও।’’
একই অবস্থা অমৃতা, সঞ্চারী, রিমাদের। রিমার মা হাতের কাজ করে সংসার চালান। দিন আনা, দিন খাওয়ার সংসারে খেলাধুলার খরচ চালানো কষ্টসাধ্য। তবু মেয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে উৎসাহী তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথম প্রথম গ্রামে অনেকে অনেক কথা বলেছিল। কিন্তু আজ এই মেয়ের প্রতিভা সব সমালোচনার জবাব দিয়েছে।’’
আর্থিক অনটনে থাকা সত্ত্বেও আজ এরা পাড়ি দিতে চলছে দেশ থেকে দেশান্তরে। একটা সময় তাদেরকে শুনতে হয়েছিল নানা অকথা, কুকথা, শুনতে হয়েছিল, ‘‘সাধারণ ঘরের মেয়ে ক্যারাটে শিখে কী হবে?’’ সেই থেকেই তারা ক্যারাটে প্রশিক্ষণকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধরে নিয়েছিল। সেখান থেকেই আজ তারা সোনার মেয়ে।