উল্লাস: প্রিয় দলের সাফল্যে এ ভাবেই একে অপরকে পাল্লা দিয়ে মেতে ওঠেন ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের সমর্থকেরা। ফাইল চিত্র
আমার জন্ম পূর্ব লন্ডনে। ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা কোন স্তরে পৌঁছতে পারে, তা ছোটবেলা থেকেই দেখেছি। কলকাতা যেমন শুধু ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান ডার্বিকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, ইল্যান্ডে কিন্তু তা নয়। একাধিক ডার্বি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য— ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড বনাম ম্যাঞ্চেস্টার সিটি। আর্সেনাল বনাম চেলসি। আর্সেনাল বনাম টটেনহ্যাম হটস্পার। লিভারপুল বনাম এভার্টন। পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে যে, ডার্বির আগে পরিবারের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়ে যায়। বাবার সঙ্গে ছেলের কথা বন্ধ। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে লড়াই। কী হয় না!
ডার্বি যে বঙ্গজীবনকেও দু’ভাগে বিভক্ত করে দেয়, ইস্টবেঙ্গলে কোচিং করানোর সুযোগ না-পেলে সেটা জানতেই পারতাম না। ২০১০ সালে প্রথম বার লাল-হলুদের দায়িত্ব নিই। কয়েক মাসের মধ্যেই মুখোমুখি হই মোহনবাগানের। তবে ইস্টবেঙ্গলের কোচ হিসেবে আমার ডার্বি অভিষেক কলকাতায় নয়, হয়েছিল কটকে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে। দেখেছিলাম, দু’দলেরই অসংখ্য সমর্থক পৌঁছে গিয়েছেন কটকে। আমি একেবারেই অবাক হইনি। বিশ্বের সর্বত্রই প্রিয় দলকে সমর্থন করতে সমর্থকেরা এক শহর থেকে অন্য শহরে যান। এর মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। ডার্বির আসল উত্তেজনা টের পেলাম কয়েক মাস পরে।
আমি থাকতাম সল্টলেকে। বাড়ি থেকে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে পৌঁছতে মিনিট দশেকের বেশি লাগত না। ডার্বির দিন দুপুরে স্টেডিয়ামের কাছাকাছি পৌঁছে চমকে গেলাম। দু’দলের হাজার হাজার সমর্থক হাতে পতাকা, মুখে রং মেখে খেলা দেখতে যাচ্ছেন। কেউ হেঁটে। কেউ কেউ গাড়িতে, ম্যাটাডর ভ্যানে চড়ে। বিপক্ষ দলের সমর্থকদের দেখলেই হুঙ্কার দিচ্ছেন। মনে হচ্ছিল যেন, ইংল্যান্ডেই রয়েছি। সেই একই রকম আবেগের বিস্ফোরণ। ফুটবল নিয়ে পাগলামি। কলকাতায় প্রথম ডার্বির আগে যে-উদ্বেগ ছিল, এই দৃশ্য তা অনেকটাই দূর করে দিল। আমি তো বড় হয়েছি এ-রকম পরিবেশেই।
আমার পরিবারের সবাই ওয়েস্ট ইউনাইটেডের অন্ধ ভক্ত। ১৯৭৯-’৮০ মরসুমে এফএ কাপের ফাইনালে ওয়েম্বলিতে ওয়েস্ট হ্যামের প্রতিপক্ষ ছিল আর্সেনাল। আমি তখন পেশাদার ফুটবলার হিসেবে সই করেছি বোর্নমুথে। কিন্তু ওয়েস্ট হ্যামের প্রতি আবেগ আগের মতোই রয়েছে। ম্যাচের আগে আর্সেনাল সমর্থকেরা আমাদের গুরুত্বই দেয়নি। রীতিমতো বিদ্রুপ করছিল। এমন ভাব করছিল, যেন চ্যাম্পিয়ন হয়েই গিয়েছে। কিন্তু ১৩ মিনিটের মধ্যেই গোল করে ওয়েস্ট হ্যামকে এগিয়ে দেন ট্রেভর ব্রোকিং। ১-০ জিতেছিলাম আমরা। হারের পরে বিধ্বস্ত আর্সেনাল সমর্থকদের দেখে খুব আনন্দ হচ্ছিল। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ চিৎকার করে বলছিল, ‘‘ম্যাচের আগে তো অনেক কথা বলছিলে। কেমন শিক্ষা দিলাম?’’
আমার এক বন্ধু ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের সমর্থক। ওর বাবা ছিলেন আবার সিটির ভক্ত। ম্যাচের আগে আমার বন্ধু বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেত। বলত, ‘‘শত্রুর সঙ্গে এক বাড়িতে থাকা সম্ভব নয়। ম্যাচ জিতে জবাব দিয়েই বাড়ি ফিরব।’’ ওকে আমরা বলেছিলাম, বাবার সম্পর্কে এই ধরনের কথা বলে? এতে আরও রেগে যেত। বলত, ‘‘ম্যাঞ্চেস্টার ডার্বি শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আমাদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই।’’ এই ছবিটা বদলায়নি। ডার্বির আগে দুই ম্যাঞ্চেস্টার, আর্সেনাল-চেলসি, লিভারপুল-এভার্টন সমর্থকেরা মুখোমুখি হলেই ঝামেলা বেধে যায়। স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে দু’দলের সমর্থকদের বসার জন্য আলাদা জায়গা রয়েছে। তাই মারামারি হত স্টেডিয়ামের বাইরে। আমি এক বার দুই ম্যাঞ্চেস্টারের সমর্থকদের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। পরস্পরের দিকে ওঁরা পয়সা ছুড়ছিলেন বৃষ্টির মতো। শেষ পর্যন্ত পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
ফুটবলার হিসেবেও অভিজ্ঞতা কম হয়নি। ব্রিস্টল সিটির সঙ্গে ব্রিস্টল রোভার্সের মারাত্মক রেষারেষির কাহিনি অনেকেই জানেন না। একই শহরের দু’টো দল হলেও সমর্থকেরা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। মাঠেও তার প্রভাব পড়ত। আমি দু’দলের হয়ে খেলেছি। যখন ব্রিস্টল সিটিতে ছিলাম, তখন মাঠে নামার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিস্টল রোভার্সের সমর্থকেরা নানা রকম ভাবে উত্ত্যক্ত করতেন। একই ঘটনার অভিজ্ঞতা হয়েছে ব্রিস্টল রোভার্সে খেলার সময়। আমরা ফুটবলারেরা অবশ্য ব্যাপারটা খুব হাল্কা ভাবেই নিতাম। এ-রকমই এক ডার্বিতে আমার প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল মাঠে। পরে অবশ্য মিটিয়ে নিয়েছিলাম।
কলকাতা ফুটবলেও একই রকম উদাহরণ রয়েছে। এক জন ইস্টবেঙ্গল সমর্থক আমাকে বলেছিলেন, তাঁর পরিবারের এক সদস্য মোহনবাগানের ভক্ত। ডার্বির আগে দু’জনের মধ্যে বাক্যালাপ বন্ধ হয়ে যেত। কলকাতায় কোচিং করাতে গিয়ে আমিও ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। মোহনবাগানের বিরুদ্ধে হার কখনওই মেনে নিতে পারিনি। এখনও যখন শুনি, ইস্টবেঙ্গল ডার্বিতে হেরেছে, খুব কষ্ট হয়।
ডার্বিতে ব্যতিক্রমী ছবিও রয়েছে। কয়েক দিন আগে ম্যাঞ্চেস্টার সিটিকে নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র দেখছিলাম। ভিনসেন্ট কোম্পানি যাঁকে বিয়ে করছেন, তাঁর বাবা ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের সমর্থক। দেখলাম, শ্বশুরের সঙ্গে বসে টিভিতে ম্যান সিটির ইপিএল জয় দেখছেন। খেলা শেষ হওয়ার পরে কোম্পানিকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন!