সেরা: এজবাস্টনে দুরন্ত সেঞ্চুরি করে আইসিসির টেস্ট ব্যাটসম্যানদের তালিকায় শীর্ষে কোহালি। —ফাইল চিত্র।
টেস্ট ও ওয়ান ডে— দুই ধরনের ক্রিকেটেই বিরাট কোহালি বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যান। ওয়ান ডে র্যাঙ্কিংয়ে তো একে ছিলেনই, এ বার আইসিসি রবিবার যে টেস্ট র্যাঙ্কিং প্রকাশ করল, তাতেও দেখা গেল বিরাটই সবার উপরে। সাত বছর আগে সচিন তেন্ডুলকরকে দুই ধরনের ক্রিকেটেরই ক্রমতালিকায় এক নম্বরে দেখা গিয়েছিল। সচিনের গড়া সেই মাইলফলকই এ বার ছুঁয়ে ফেললেন বিরাট। আর কত মাইলফলক তিনি ছোঁবেন ও গড়বেন, কে জানে!
স্টিভ স্মিথকে সরিয়ে বিরাটের টেস্ট শীর্ষে ওঠার এই খবর ছড়ানোর পরে দেখলাম সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই আলোচনাটা ফের শুরু হয়েছে। বিরাট ও সচিনের মধ্যে কে বড় ব্যাটসম্যান? নানা বিতর্ক, নানা আলোচনা। এমনকী সুনীল গাওস্করকেও টেনে আনা হচ্ছে এই তুলনার মধ্যে। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে গাওস্কর, সচিন, বিরাটের মধ্যে কে বড় ব্যাটসম্যান?
এই বিতর্কে ঢুকতেই চাইছি না। বিয়র্ন বর্গের সঙ্গে যেমন পিট সাম্প্রাসের তুলনা হয় না, পিট সাম্প্রাসের সঙ্গে যেমন রজার ফেডেরারের তুলনা করা যায় না, তেমনই তিন যুগের এই তিন সেরা ব্যাটসম্যানের মধ্যেও তুলনার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। যুগ পাল্টানোর সঙ্গে পরিবেশ, পরিস্থিতি, বিপক্ষের বোলার, উইকেটের চরিত্র, তীব্রতা, চাপ— সব কিছুই যেখানে বদলে গিয়েছে, সেখানে এই তুলনার কোনও মানেই হয় না।
সুনীল গাওস্কর একসময় বিনা হেলমেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের দুর্ধর্ষ সব পেসারদের সামলেছেন। তখন পেস সহায়ক উইকেট দেখা যেত সে সব দেশে। সচিন তেন্ডুলকর একদিকে যেমন গ্লেন ম্যাকগ্রার মতো পেসার সামলেছেন, তেমনই শেন ওয়ার্ন, মুথাইয়া মুরলীধরনের মতো স্পিনারদেরও খেলেছেন। কিন্তু বিরাট কোহালি সেই যুগের ব্যাটসম্যান যে যুগে ক্রিকেটের তীব্রতা, আগ্রাসন, বিতর্ক ও নজরদারি সব কিছুই বেশি। যা সচিন, গাওস্করদের সময় এত ছিল না। তাই তুলনা টানার চেষ্টা না করে বিরাটের মতো একজন বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান যে আমাদের দেশেরই সম্পদ, এই ভেবে গর্বিত হওয়াই ভাল।
টেস্ট ক্রিকেটে সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আর কতজন ব্যাটসম্যান-অধিনায়কের রয়েছে? অনেকে তাঁর সঙ্গে স্টিভ স্মিথের তুলনা করেন ঠিকই। তবে স্টিভ বোধহয় তাঁর দলকে এতটা প্রভাবিত করতে পারেননি, যতটা বিরাট ভারতীয় দলে প্রভাব ফেলেছেন। এবং বেশির ভাগটাই তাঁর দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের মাধ্যমে। এজবাস্টনে যেমন একাই বুক চিতিয়ে লড়াই করে গেলেন বিরাট, তেমনই ২০১৪-য় অ্যাডিলেডেও তাঁর লড়াই মনে ছিল রাখার মতো। দুই ইনিংসেই তাঁর সেঞ্চুরি সত্ত্বেও দল জিততে পারেনি সতীর্থদের ব্যর্থতায়।
আরও পড়ুন: কোহালিকেই সেরা ব্যাটসম্যান বাছলেন ব্রিয়ারলি
অধিনায়কত্ব পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলেছে, এমন উদাহরণ প্রচুর আছে। সচিন তেন্ডুলকরও একটা সময়ে অধিনায়কত্বের চাপ নিতে পারেননি। তিনি শুধু মন দিতেন চাইতেন তাঁর ব্যাটিংয়ে। আশেপাশে কী হচ্ছে, কে কী পারফর্ম করছে বা কী বলছে, সে সব দিকে মন দেওয়া তাঁর একদমই পছন্দ ছিল না। তাই অধিনায়কের ভূমিকাটা খুব একটা উপভোগ করতে পারেননি। বিরাট কিন্তু নেতৃত্ব ও নিজের পারফরম্যান্স সমান ভাবে বজায় রেখে চলেছেন। সঙ্গে ক্রিকেটের বাইরের জীবনটাও উপভোগ করছেন সমান ভাবে। ক’জনের এই ক্ষমতা আছে?
অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটারদের বিপক্ষের ক্রিকেটারদের সঙ্গে মাথা উঁচু করে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে শিখিয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই ধারা বজায় রেখে চলেছেন বিরাট।
এর এই আত্মবিশ্বাস ও আগ্রাসন তখনই কারও মধ্যে দেখা যায়, যাঁর নিজেকে সেরার জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ও সেই জায়গায় ধরে রাখার ক্ষমতা আছে। যে ব্যাটসম্যান অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ডে গিয়ে স্বমহিমায় বড় রান করেছেন। সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন (২২টির মধ্যে ১২টি টেস্ট সেঞ্চুরিই বিদেশে), তাঁকে সেরা ছাড়া আর কী বলা যাবে?
সব চেয়ে বড় কথা, ওঁর অসাধারণ ফিটনেস। কপিলদেব ছা়ড়া আর কোনও ভারতীয় অধিনায়ককে এত ফিট দেখিনি। তা ছাড়াও অনেক দিন পরে দেখছি, একজন ভারতীয় ব্যাটসম্যানকে বোলাররা ভয় পাচ্ছেন। সচিনকে বোলাররা সমীহ করতেন। বিরাটকে কিন্তু অনেকে ভয় পান, যেমন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভিভিয়ান রিচার্ডসকে পেতেন। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় অধিনায়ক সৌরভ ও ব্যাটসম্যান সচিন ও ভিভের মিশ্রণ এই বিরাট কোহালি। যাঁর বয়স সবে ২৮। আরও সাত-আট বছর অনায়াসে ক্রিকেট দুনিয়া মাতাবেন। কত নজির, মাইলফলক যে গড়বেন, কে জানে! সচিনের একশো সেঞ্চুরির নজিরও ভেঙে দেবেন হয়তো। আমরা সেই দিনের দিকেই তাকিয়ে থাকব।