Sanjiv Goenka

মোহনবাগানে সফল হলেও লখনউ বার বার হতাশ করছে তাঁকে! ফুটবলে ‘সুপার জায়ান্ট’ সঞ্জীব ক্রিকেটে কেন ‘বামন’?

ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৭টা কোম্পানির মালিক সঞ্জীব গোয়েন্‌কার সম্পত্তির পরিমাণ ৩৭,৫০০ কোটি টাকা। প্রতি দিনই ব্যবসা বাড়াচ্ছেন তিনি। সফল হচ্ছেন। শুধু লখনউ তাঁকে ডুবিয়ে দিচ্ছে।

Advertisement

দেবার্ক ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২৫ ১১:১৬
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

৬৪ বছরের সঞ্জীব গোয়েন্‌কা সম্প্রতি দাদু হয়েছেন। তাঁর পুত্র শাশ্বতের সন্তান জন্ম নিয়েছে। কিন্তু সেই সন্তানের তরফে সুখবরের পাশাপাশি গোয়েন্‌কার অপর ‘সন্তান’-এর তরফে এ বছরেও দুঃসংবাদই এল। এ বারেও আইপিএলের প্লে অফে উঠতে পারল না লখনউ সুপার জায়ান্টস।

Advertisement

দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিদের একজন সঞ্জীব। পূর্ব ভারতের অন্যতম বড় শিল্পপতি তো বটেই। পিতা রমাপ্রসাদ গোয়েন্‌কা দুই পুত্র হর্ষ ও সঞ্জীবকে সম্পত্তি ভাগ করে দেওয়ার পর থেকে দু’জনে নিজেদের মতো করে নিজেদের ব্যবসা সামলেছেন। হর্ষ থেকেছেন মুম্বইয়ে। সঞ্জীব পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কলকাতাকেই তাঁর ব্যবসার ভরকেন্দ্র করেছেন। সিইএসসি-র মালিক সঞ্জীব কলকাতায় একের পর এক ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। পার্ক সার্কাসের শপিং মল, গেরস্তালির তৈজসপত্র থেকে রেডিমেড পোশাকের বিপণির ‘চেন’ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য পরিষেবা। ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৭টা কোম্পানির মালিক সঞ্জীবের সম্পত্তির পরিমাণ ৩৭,৫০০ কোটি টাকা। প্রতিনিয়ত ব্যবসা বাড়াচ্ছেন। বিকেন্দ্রীকরণ করছেন। বিভিন্ন মাপে সফলও হচ্ছেন। শুধু লখনউ নিয়ে তিনি এখনও সাফল্যের মুখ দেখেননি। আইপিএলের দল কিনতে ভরপুর বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু লাভের কড়ি গুনতে পারেননি।

অনেকে বলেন, ক্রিকেট সঞ্জীবের ‘প্রেম’। সেই প্রেম থেকেই তাঁর আইপিএলের দল কেনা। আবার অনেকের মতে, সঞ্জীবের আসল টান ফুটবলেই। ক্রিকেট তাঁর কাছে আরও অনেক ব্যবসার মতো। যাতে বিনিয়োগ করা যায়। সেই ক্রিকেট ব্যবসার একেবারে চূড়ায় রয়েছে ক্রোড়পতি লিগ আইপিএল। ফলে সেখানে বিনিয়োগ নয় কেন?

Advertisement

কথিত যে, ২০০৮ সালে কলকাতা নাইট রাইডার্স কিনতে গিয়েছিলেন সঞ্জীব। ময়দানে শাহরুখ খান এসে পড়ায় খানিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও পিছিয়ে আসেন। কিন্তু সুযোগ পেয়ে ২০১৬ সালে কিনেছিলেন রাইজ়িং পুণে সুপার জায়ান্টস। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে সেই দল আইপিএলে খেলেছিল। এক বার ফাইনালেও গিয়েছিল। কিন্তু চেন্নাই সুপার কিংস ফিরে আসায় পুণের অবলুপ্তি ঘটে। সঞ্জীব অবশ্য তাতে দমে যাননি। তক্কে তক্কে ছিলেন। ২০২২ সালে ৭,০৯০ কোটি টাকা দিয়ে লখনউ কিনে নেন তিনি। তথ্য বলছে, সেই দলের বাজারদর এখন ১২,০০০ কোটি টাকা। ফলে ট্রফি না এলেও লোকসান নেই। সঞ্জীব জানিয়েছিলেন, ১৫ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে দল কিনেছেন। শিল্পপতি সঞ্জীব জানতেন, আরও বড় হবে আইপিএল। জানতেন, ভারতে জনপ্রিয়তার নিরিখে ক্রিকেটের ধারেকাছে কোনও খেলা নেই। হবেও না। ক্রিকেটবিশ্বের ধনীতম লিগ আইপিএলে অনেক নামী শিল্পপতিই যুক্ত হচ্ছেন। যেমন মুকেশ অম্বানী। কিন্তু মুকেশের মুম্বই ইন্ডিয়ান্স পাঁচ বার আইপিএল জিতেছে। সঞ্জীবের পুণে এবং লখনউ সেখানে ব্যর্থ।

ফুটবল অবশ্য সঞ্জীবকে খালিহাতে ফেরায়নি। ২০২০ সালে মোহনবাগানের ফুটবল দলের মালিক হয়েছিলেন তিনি। যদিও ক্রিকেটের মতো ফুটবলের প্রতি তাঁর অতটা টান নেই। একাধিক সময়ে সঞ্জীব জানিয়েছেন, ক্রিকেট তাঁর আবেগের জায়গা। আর মোহনবাগানের ফুটবল দল তিনি কিনেছিলেন ব্যবসার জন্য। যে কলকাতায় তাঁর বাণিজ্যের বুনিয়াদ, সেখানে একটা ফুটবল দলের লক্ষ লক্ষ সমর্থকের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার ইচ্ছা থেকেই মোহনবাগানের ফুটবল দল কেনা। বিনিয়োগ। এবং সেই বিনিয়োগে তিনি সফল। মোহনবাগানকে গত তিন বছরে ভারতের সেরা ফুটবল ক্লাব (পাঁচটি ট্রফি) করতে পেরেছেন।

সেই সাফল্যের নেপথ্যে একটি নাম রয়েছে— বিনয় চোপড়া। মোহনবাগানের ফুটবল দল তিনিই চালান। পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বিনয় দীর্ঘ দিন আরপিএসজি-র (সঞ্জীব গোয়েন্‌কার সংস্থা) সঙ্গে যুক্ত। আগে পার্ক সার্কাসের শপিং মলটি পরিচালনার পুরো দায়িত্ব ছিল তাঁর। অতঃপর সঞ্জীব তাঁকে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের দায়িত্বও দেন। পরিচিতেরা বলেন, বিনয় ফুটবল বোঝেন। তাই দলের ফুটবলার থেকে শুরু করে কোচ এবং সাপোর্ট স্টাফ নিয়োগ সম্পর্কে তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। এবং সেই সিদ্ধান্ত হয় সম্পূর্ণ পেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। গত তিন বছরে মোহনবাগানে বিনয়ের সাফল্য দেখে তাঁকে ক্রিকেট দলগুলির দায়িত্বও দিয়েছেন সঞ্জীব। তবে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে হালে। ঘটনাচক্রে, এ বার আইপিএল এবং আইএসএল একই সময়ে হয়েছে। অনেকে মনে করেন, তারও ‘খেসারত’ দিতে হয়েছে লখনউকে। দু’টি দলেরই দায়িত্ব ছিল বিনয়ের হাতে। ফুটবলে শুরু থেকেই মোহনবাগান চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দিকে এগোচ্ছিল। দ্বিমুকুট জয়ের সম্ভাবনা ছিল। অনেকে মনে করেন, বিনয়ের লক্ষ্য সম্ভবত বেশি ছিল ফুটবলের দিকে। ক্রিকেটে ততটা মন দিতে পারেননি। ক্রিকেটে মনোযোগ দিতে পারেন কি না, পারলেও সাফল্য পান কি না, তা দেখতে আইপিএল ২০২৬ পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

অনেকে মনে করেন, ফুটবলের ক্ষেত্রে ‘কঠোর এবং পেশাদার সিদ্ধান্ত’ নেওয়ার ক্ষেত্রে যে সক্রিয়তা সঞ্জীব দেখাতে পেরেছেন, ক্রিকেটে এখনও পর্যন্ত তা পারেননি। অন্তত লখনউয়ের ক্ষেত্রে। তবে পেশাদার ব্যবসায়ীরা লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষেন বারবার। সেই অঙ্কের ভিত্তিতে ক্ষতির কারণ মেরামত করার চেষ্টা করেন। এ বারের আইপিএলে ব্যর্থতার কারণও খুঁজবেন সঞ্জীব। কারাও না কারও উপর সেই ‘দায়’ বর্তাবে তো বটেই। ক্রিকেট প্রশাসনের সঙ্গে জড়িতদের একাংশের পূর্বাভাস, লখনউয়ের ‘মেন্টর’ তথা প্রাক্তন ভারতীয় বোলার জাহির খান দলের মালিকের খুব ‘সুনজরে’ নেই। এখন দেখার, সেই কড়া সিদ্ধান্ত সঞ্জীব নিতে পারেন কিনা।

ঘটনাচক্রে, এই সঞ্জীবই ২০১৬ সালের আইপিএলে পুণে সফল না হওয়ায় পরের বছর মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে নেতৃত্ব থেকে সরাতে দ্বিধা করেননি। ধোনি তখনও সাদা বলের ক্রিকেটে ভারতীয় দলের অধিনায়ক। তিনটি আইসিসি ট্রফি জিতে ফেলেছেন। আইপিএলে চেন্নাইকে দু’বার চ্যাম্পিয়ন করে ফেলেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধোনিকে সরিয়ে স্টিভ স্মিথকে অধিনায়ক করতে সঞ্জীব দু’বার ভাবেননি। ক্রিকেটচক্রে, তাঁর সেই সিদ্ধান্ত ফলদায়ী হয়েছিল। স্মিথ ফাইনালে তুলেছিলেন দলকে। মুকেশের মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের কাছে ১ রানে না-হারলে সে বারই ‘সফল’ হয়ে যেতেন সঞ্জীব।

অনেকে মনে করেন, লখনউয়ের ক্ষেত্রে সঞ্জীব অতটা ‘কড়া’ হতে পারেননি। তার কারণও রয়েছে। গত বার ব্যর্থতার পর মাঠেই তারকা ক্রিকেটার লোকেশ রাহুলকে ধমকেছিলেন সঞ্জীব। তার জন্য বিভিন্ন মহলে সমালোচিত হতে হয়েছিল তাঁকে। কারণ, ভারতে ক্রিকেট এবং ক্রিকেটারেরা একটা ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা হন। তাঁরা প্রায় ঈশ্বরের কাছাকাছি। তাঁদের সঙ্গে কোনও ‘বেচাল’ করলে মুশকিল। চাপে পড়ে কয়েক দিন পর দিল্লির বাড়িতে রাহুলকে আমন্ত্রণ করে খাওয়ান সঞ্জীব। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। রাহুল লখনউ ছেড়ে চলে যান দিল্লি টিমে। ঘটনাচক্রে, এ বারের আইপিএলে দিল্লির কাছে (রাহুলের দলের কাছে) দু’টি ম্যাচেই হেরেছে সঞ্জীবের লখনউ।

পেশাদারি জগতের সঙ্গে যুক্তদের একাংশ মনে করেন, রাহুলকে তাঁর মনোভাব জানিয়ে ভুল করেননি সঞ্জীব। তিনি ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির মালিক। সে অর্থে দেখতে গেলে যে কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির যে কোনও ক্রিকেটারই তাঁর মালিকের আজ্ঞাবহ। এ বারের আইপিএলেও দেখা গিয়েছে, বাউন্ডারি লাইনের ধারে বসে মুম্বই টিমকে ডিআরএস নেওয়ার জন্য হাত-টাত নেড়ে কার্যত নির্দেশ দিচ্ছেন মুকেশ এবং নীতা অম্বানীর পুত্র। সেই সূত্রেই অনেকে মনে করেন, টিম পর পর হারতে থাকলে মালিকের উষ্মা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে একই সঙ্গে তাঁদের বক্তব্য, সেই উষ্মা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করলে মুশকিল। তাঁরা উদাহরণ দিচ্ছেন ধোনি এপিসোডের। যেখানে প্রায় নিঃশব্দে ভারতের অন্যতম সফল অধিনায়ককে ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দিতে পেরেছিলেন সঞ্জীব।

যা তিনি করতে পারলেন না ঋষভ পন্থের ক্ষেত্রে। ২৭ কোটি টাকার অবিশ্বাস্য দামে পন্থকে কিনেছিলেন সঞ্জীব। তিনি অধিনায়ক হিসাবে ব্যর্থ, ব্যাটার হিসাবে দেড়খানা ম্যাচ ছাড়া চূড়ান্ত ব্যর্থ এবং উইকেটরক্ষক হিসাবেও নিজের সুনামের প্রতি সুবিচার করতে অসফল। কিন্তু পন্থকে সরিয়ে এডেন মার্করাম বা মিচেল মার্শকে মরসুমের মাঝপথে অধিনায়ক করতে পারেননি সঞ্জীব। উল্টে রাহুলপর্বের কথা মাথায় রেখে ম্যাচের পর ম্যাচ গোহারা হেরেও মাঠে গিয়ে পন্থের সঙ্গে হাসিমুখে (সম্ভবত একটু বেশিই হাসিমুখে) কথা বলতে হয়েছে।

অথচ, মোহনবাগানের সমস্যা সামলে নিয়েছিলেন সঞ্জীব। শুরুতে মোহনবাগান নামের আগে ‘এটিকে’ থাকায় সবুজ-মেরুন সমর্থদের একটা বড় অংশ বিক্ষোভ করেছিলেন। মিছিলও বেরিয়েছিল। কিন্তু প্রথম বার আইএসএল কাপ জিতে নাম বদলে ফেলেন তিনি। ‘এটিকে মোহনবাগান’ হয়ে যায় ‘মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট’। তাতে সমর্থকদের গোসা কমাতে পেরেছিলেন সঞ্জীব। পাশাপাশিই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেননি। গত বার মোহনবাগানকে লিগ-শিল্ড জেতানো আন্তোনিয়ো লোপেস হাবাসের মতো কোচকে এ বার সরিয়ে দিতে পিছপা হননি। তাতে সাফল্য কমেনি। বেড়েছে।

সঞ্জীবকে অবশ্য পরোক্ষে সাহায্য করেছে ভারতীয় ফুটবলের পরিস্থিতি। ফিফা ক্রমতালিকায় নামতে নামতে ভারত এখন কোথায়, চট করে কেউ বলতে পারবেন না। যেমন বলতে পারবেন না, ভারতের পরের ম্যাচ কোথায় এবং কবে। ফলে ভারতের ফুটবল নিয়ে আগ্রহও কমছে। কলকাতার ফুটবলপ্রেমীরা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলে ভাগ হয়ে এখনও আবেগজর্জর পোস্ট-টোস্ট করেন বটে। কিন্তু ক্রিকেটের সেই ‘কৌলীন্য’ ফুটবলে নেই। সেই অর্থও নেই। সেই কারণেই ফুটবলের সাফল্য নিয়ে বাজি ধরারও তত আগ্রহ নেই।

ক্রিকেটে আছে। আইপিএলে আছে। বিভিন্ন বাণিজ্যে সফল হয়েছেন শিল্পপতি সঞ্জীব। ক্রিকেটশিল্পে সাফল্যলক্ষ্মী এখনও তাঁর অধরা। আইপিএলের মাঠে আসলে লড়াই হচ্ছে সঞ্জীব বনাম সঞ্জীব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement