স্ত্রীর প্রেরণায় অন্ধকার থেকে আলোয় আদিল

বুধবার বিকেলে গোয়া পৌঁছে  ইগর স্তিমাচের দলের চব্বিশ ঘণ্টা আগের রক্ষাকর্তা আদিল একান্ত সাক্ষাৎকারে আনন্দবাজারকে বলে দিলেন, ‘‘ছয় মাস আগে বিয়ে করার পরেই আমার জীবনের চাকা ঘুরে গিয়েছে।”

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৯ ০৫:৩৮
Share:

জুটি: স্ত্রী খুরি ইরানির সঙ্গে আবেগঘন মুহূর্তে আদিল। বাংলাদেশ ম্যাচে তিনিই ছিলেন ভারতের রক্ষাকর্তা। ফাইল চিত্র

সুনীল ছেত্রী প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি মঙ্গলবার। বাংলাদেশের কাছে গোল খেয়ে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া যুবভারতীতে গোল করে এবং করিয়ে শেষ পর্যন্ত যিনি স্বস্তি এনে দিয়েছিলেন তেষট্টি হাজার সমর্থকের, সেই আদিল আহমেদ খান স্বীকার করে নিলেন, ‘লেডি লাক’ সঙ্গে ছিল বলেই তিনি সফল হয়েছেন।

Advertisement

বুধবার বিকেলে গোয়া পৌঁছে ইগর স্তিমাচের দলের চব্বিশ ঘণ্টা আগের রক্ষাকর্তা আদিল একান্ত সাক্ষাৎকারে আনন্দবাজারকে বলে দিলেন, ‘‘ছয় মাস আগে বিয়ে করার পরেই আমার জীবনের চাকা ঘুরে গিয়েছে। স্ত্রী খুরি ইরানি আমার জীবনে না আসলে হয়তো ফুটবল থেকেই ছিটকে যেতাম। ও তো ফুটবল মাঠের মেয়ে। খুরি আমার লেডি লাক। শুনেছি সব সফল মানুষের পিছনেই থাকে একজন মেয়ের অবদান। আমি সেটা বিশ্বাস করি।’’

ভারতীয় ফুটবলে যা কখনও ঘটেনি, সেই দৃশ্য দেখা গিয়েছে মঙ্গলবার বিশ্বকাপ যোগ্যতা অর্জন পর্বের ম্যাচের পরে। খেলার শেষে পেশায় টেলিভিশন সঞ্চালক খুরি সাক্ষাৎকার নেন তাঁর স্বামী এবং ম্যান অব দ্য ম্যাচ আদিলের। সেরা হয়ে কেমন লাগছে, বলতে গিয়ে আনন্দে গলা ধরে আসে সুন্দরী স্ত্রীর। ক্যামেরার সামনেই চুম্বনে ভরিয়ে দেন স্বামীকে। কেমন লাগছিল তখন? ‘‘অসাধারণ একটা অনুভূতি হচ্ছিল। যার প্রত্যেক দিনের সাহচর্যে এই সাফল্য এসেছে, সে-ই জানতে চাইছে কেমন লাগছে.....। ঠিক বলে বোঝাতে পারব না ওই মিনিট পাঁচেকের সময়টা। সত্যি বলতে, বিয়ের দিনের আনন্দের সঙ্গে ওই মুহূর্তের তুলনা করতে পারি। জাতীয় দলের জার্সিতে জীবনের প্রথম গোল এবং ম্যাচের সেরা। এমন দিন কখনও জীবনে আসতে পারে ভাবিনি,’’ ফোনে বলছিলেন বছর একত্রিশের আদিল।

Advertisement

গোয়ার বাণিজ্য শহর মারগাওয়ের ফতোরদা স্টেডিয়ামের পাশেই ভারনায় বাড়ি সুঠাম চেহারার আদিলের। ভারতীয় ফুটবলের নতুন তারকাকে যখন কেউ চিনত না, তেমনই একদিন এসএমএস করে প্রেম নিবেদন করে বসেন আইএসএলে গত পাঁচ বছরের টেলিভিশনে পরিচিত মুখ খুরি। আকর্ষণীয় খুরিকে নিয়ে নানা গুঞ্জন শোনা যেত ফুটবল মহলে। সেই মেয়েই কেন আদিলকে বাছলেন তাঁর স্বামী হিসাবে? সুঠাম চেহারা, লম্বা চুল, শান্ত স্বভাবের জন্য। হাসতে হাসতে আদিল বলে দেন, ‘‘সেটা আমি জানি না। তবে আমাদের বছর খানেকের প্রেম ছিল। ওর ইচ্ছাতেই চুলের স্টাইল পাল্টেছিলাম। ঝুঁটিও বাঁধি মাঠে। খুরি আদন্ত্য পেশাদার। জীবনের দুঃসময়ে আমি যখন চোটে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিলাম, তখনই আমার মেন্টর হয়ে জীবনে আসে খুরি। বিশ্বাস করুন ওকে বিয়ে করার পরেই জাতীয় দলে প্রথম ডাক পাই।’’

স্তিমাচের দলের স্টপার আদিলের এগারো বছরের ফুটবল জীবন চড়াই-উতরাইতে ভরা। সেসা গোয়ার অ্যাকাডেমি থেকে উঠে আসা স্টপার একসময় খেলে গিয়েছেন কলকাতায়। পাঁচ বছর আগে মোহনবাগানের জার্সিতে। আইএসএলের শুরুতে দিল্লি ডায়ানোমোজে সই করেছিলেন। সাফল্য পাননি। দল না পেয়ে চলে যান লোন স্টার কাশ্মীরে। ‘‘সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। বোমা, গুলি, হরতাল— নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের অনুশীলন করতে হত। স্থানীয় ছেলেরা ভয়ে মাঠে আসত না। আমরা বাইরের কয়েকজন অনুশীলন করতাম। জিম, সাঁতার, নানা রকম শারীরিক সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করতাম। ফিটনেস বাড়ানোর পাশাপাশি ভাবতাম, এত অনুশীলন তো করছি, শেষে ক্লাব পাব তো! ফুটবল ছাড়া আমি তো বেকার।’’ বলার সময় অদ্ভুত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন আদিল। বলতে থাকেন, ‘‘আমি আলো এবং অন্ধকার দুই-ই দেখে ফেলেছি। বলতে পারেন, খুরি আমাকে অন্ধকার থেকে
আলো দেখিয়েছে।’’

সাক্ষাৎকারের সময় প্রতিটি কথায় ঘুরে ফিরে আসছিল স্ত্রী-র প্রসঙ্গ। কাশ্মীরের অন্ধকার থেকে হঠাৎ-ই আদিল ডাক পান ডেম্পোয়। খেলেন গোয়া লিগে। তারপর চার্চিল ব্রাদার্সে চলে যান। ‘‘চার্চিলে আমি যে ফুটবল খেলেছিলাম, তাতে জাতীয় দলে ডাক পাওয়া উচিত ছিল। প্রত্যাশায় থাকতাম। সেই সময় ভারতীয় দলের কোচ স্টিভন কনস্ট্যান্টাইন আমাকে ডাকেননি,’’ রুক্ষ হয় আদিলের গলা। চার্চিল থেকে পুণে সিটিএফসি-তে সই করেন আদিল। বলছিলেন, ‘‘স্তিমাচই আমাকে প্রথম জাতীয় শিবিরে ডাকেন। এবং সেটা আমার বিয়ের কিছুদিন পরেই। খুরি নিজের পেশাদার ব্যস্ততার মধ্যেই আমাকে প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করত। তাই কোচ স্তিমাচের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’’

সুনীল ছেত্রীর মতোই বাংলাদেশ ম্যাচ না জিততে পেরে হতাশ আদিল। বললেন, ‘‘খুব আশা করেছিলাম ম্যাচটা জিতব। এখন আমাদের লক্ষ্য প্রথম রাউন্ডের বাকি দুটি ম্যাচ থেকে ছয় পয়েন্ট পাওয়া। ওমান এবং আফগানিস্তান ম্যাচ থেকে পুরো পয়েন্ট পেলে আবার দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার স্বপ্ন দেখা সম্ভব।’’ প্রশ্ন করা হল সমতায় ফেরার গোল না কি গোললাইন থেকে দলকে রক্ষা করার মুহূর্ত, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? আদিল বললেন, ‘‘দু’টোই। গোলটা না বাঁচালে ২-০ হয়ে যেত। একটা পয়েন্টও পেতাম না। আর গোলটা না করলে দর্শকরা নিরাশ হয়ে ফিরতেন।’’ যোগ করলেন, ‘‘জাতীয় দলের জার্সিতে জীবনের প্রথম গোল আরও উপভোগ করতে পারতাম, যদি ভারত জিতত।’’

আপাতত অন্য ফুটবলারদের মতো আদিলও আইএসএলে খেলতে নামবেন। পুণের নাম বদলে হায়দরাবাদ এফসি হয়েছে এ বার। সেখানেও আদিলের সঙ্গে মাঠেই দেখা হবে খুরির। কারণ আইএসএল সম্প্রচার সংস্থার সঞ্চালক হিসেবেই থাকবেন তিনি। সেখানেও ‘লেডি লাক’ কাজ করে কি না, সেটাই দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন