ভারতীয় সময় আন্দাজ রাত সাড়ে দশটা। স্থান এমিরেটস প্যালেস, আবু ধাবি।
মুখ্য দুই মুখ, শাহরুখ খান এবং বিরাট কোহলি।
“আরে বিরাট, দ্যাখো তো তোমার কী রকম মেয়ে পছন্দ?” বলতে বলতে তিন-চারটে ছবি বের করলেন কিং খান। প্রথমে চারটে, তার পর দু’টো, শেষে একটা। আর শেষেরটা কার? কেন, অনুষ্কা শর্মার! বিরাট দেখলেন এবং হাসতে হাসতে নিজের পার্স থেকে অনুষ্কার ছবি বার করে বলে দিলেন, “এটার জন্য এত খাটাখাটনি করার কী দরকার ছিল? এ তো আমার কাছেই ছিল!” করুণ মুখে শাহরুখও এ বার পার্স খুললেন, অনুষ্কারই আর একটা ছবি বার করে বিরাটের হাতে ধরিয়ে বলে উঠলেন, “একটাই ছিল। এ বার এটা তুমিই রেখে দাও!”
ভারতীয় সময় আন্দাজ রাত সাড়ে ন’টা। স্থান নয়াদিল্লি।
মুখ্য দুই মুখ, আদিত্য বর্মা এবং নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন।
“ও নাটক করে বাঁচবে ভাবছে? আদিত্য বর্মাকে তা হলে এখনও চেনে না। কী জঘন্য লোক ভাবুন, আবেদনে বলে কি না সুনীল গাওস্করকেও ও বিশ্বাস করে না,” ফোনের ও পার থেকে ক্রুদ্ধ হুঙ্কার বিহার ক্রিকেট সংস্থার সচিবের। কয়েক ঘণ্টা আগে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা জমা করে অপসারিত বোর্ড প্রেসিডেন্ট প্রশ্ন তুলেছেন, “কেন আমাকে সরানো হল?” হলফনামায় শ্রীনি পরিষ্কার বলেছেন, যে ভাবে ২৭ মার্চের শুনানিতে তাঁর বিরুদ্ধে অন্যায়, অপ্রমাণিত অভিযোগ উঠেছে তাতে তিনি ব্যথিত! তিনি এটাও বুঝতে পারছেন না, কেন তাঁকে বোর্ড প্রেসিডেন্টের চেয়ারে থাকতে দিল না সুপ্রিম কোর্ট! ইন্ডিয়া সিমেন্টসও নাকি কোনও গর্হিত কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে নেই।
আবু ধাবির কিং খান রাজকীয় মেজাজে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে ‘লুঙ্গি ডান্স’-এ নাচানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দেখে কে বলবে, রাত পোহালে তাঁর টিম উদ্বোধনী যুদ্ধে নামছে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে?
চেন্নাইয়ের শ্রীনিবাসন অসম্ভব চাপে। প্রহর গুনছেন সুপ্রিম কোর্টে আইপিএল মামলার শুনানির। যা উঠছে আজ, বুধবার। যেখানে তাঁর জোড়া হলফনামা পেশের জবাবি অস্ত্র হিসেবে তিন ওষুধ পেশ করতে যাচ্ছেন আদিত্য বর্মা।
আমিরশাহির আইপিএল-কাণ্ডে যতটা আমিরি মেজাজ, সুপ্রিম কোর্টের আইপিএল-কাণ্ডকে ঘিরে ঠিক ততটাই দৈন্যদশা!
কী হল নয়, এমিরেটস প্যালেসের আইপিএল-উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কী হল না, সেটাই প্রশ্ন! দীপিকা পাড়ুকোনের পারফরম্যান্স, আতসবাজির ধুন্ধুমার প্রদর্শনী পর্যন্ত সব এগোচ্ছিল আর পাঁচটা আইপিএল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের নিয়ম মেনে। কিন্তু দৃশ্যপট পুরো পাল্টে যায় কেকেআর মালিক স্টেজ দখল করার পর। একটা বিশাল ওয়েডিং ইনভিটেশন বার করে বিভিন্ন ছবি কোহলিকে দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত বের হল অনুষ্কার ছবি। প্রভূত কৌতুকের শেষে ওই ছবি সোজা ঝুলিয়ে দিলেন বিরাটের গলায়!
এত দিন পর্যন্ত বিরাট-অনুষ্কার সম্পর্ক নিয়ে জল্পনা প্রকাশ হচ্ছিল শুধু মিডিয়ায়। কখনও অনুষ্কার সঙ্গে দেখা করতে বিরাট শ্রীলঙ্কা উড়ে গিয়েছেন। কখনও নিউজিল্যান্ডের রাস্তায় দু’জনকে হাত ধরে ঘুরতে দেখা গিয়েছে বলে লাফিয়ে পড়েছে মিডিয়া। কিন্তু আমিরশাহির মোহিনী রাতের আগে পর্যন্ত না বিরাট, না অনুষ্কা কেউ কোথাও সম্পর্কের কথা স্বীকার করেননি। যেটা প্রায় স্বীকৃতি পেয়ে গেল বলিউড বাদশার পাল্লায়! আর শুধু আরসিবি অধিনায়ক বিরাট কেন? বাকি অধিনায়কদেরও শাহরুখ ছাড়লেন না। ‘লুঙ্গি ডান্সে’-র সঙ্গে নাচিয়ে দিলেন। যে নাচে রীতিমতো লড়াই চলল মুম্বই অধিনায়ক রোহিত শর্মা, সানরাইজার্স ক্যাপ্টেন শিখর ধবন এবং বিরাটের মধ্যে। এখানেও জয়ী বিরাট। ‘ওই দ্যাখো, দীপিকা পর্যন্ত তোমার নাচ দেখতে চাইছে’ বলে ধোনিকেও নাচানোর চেষ্টা করেছিলেন কিং খান। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। ভারত অধিনায়ককে নিয়ে অবশ্য এর পর আস্ত একটা ম্যাজিক শো-র বন্দোবস্ত করে ফেললেন শাহরুখ! সব দেখেশুনে অনুষ্ঠানে উপস্থিত আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় আবু ধাবি থেকে ফোনে বলে ফেললেন, “অবিশ্বাস্য একটা অনুষ্ঠান!”
ভারতীয় ক্রিকেট ও আইনজীবী মহলেরও যেমন শ্রীনির হলফনামাকে ‘অবিশ্বাস্য’ মনে হচ্ছে। ২৭ মার্চের শুনানির পর এত দিন কেটে যাওয়ার পর কেন আবেদন করলেন শ্রীনি? সেটাও সুপ্রিম কোর্টে আইপিএল মামলার শুনানির চব্বিশ ঘণ্টা আগে? বলা হচ্ছে, শ্রীনির আবেদনের অর্থ আদতে চূড়ান্ত রায় আরও পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। বোর্ডের প্রাক্তন আইনজীবী উষানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, “শুধু এটা কেন, মুদগল কমিশনের সামনে ধোনিদের সাক্ষ্যের ট্রান্সস্ক্রিপ্ট বোর্ডের চাওয়া, সবই তো ব্যাপারটাকে পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।” যা সফল হলে লাভ শ্রীনিরই।
কী সেই লাভ? এক) মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আরও পিছিয়ে যাওয়া মানে আইপিএল সেভেন ততক্ষণে শেষ। সিএসকে টুর্নামেন্ট খেলে ফেলবে। দুই) মামলা আরও টেনে নিয়ে যেতে পারলে আইসিসি চেয়ারম্যানের চেয়ার দখলেও আর অসুবিধে থাকবে না। তিন) ৪ মে থেকে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ সুপ্রিম কোর্টে গরমের ছুটি। তার মধ্যে ফিক্সিং-মামলার অন্যতম প্রধান বিচারপতি এ কে পট্টনায়েক অবসর নিয়ে নেবেন। কোনও ভাবে ৪ মে-র পর মামলার শুনানি ঠেলে দেওয়া মানে নতুন বেঞ্চের হাতে শ্রীনির ভাগ্য নির্ধারণ। যিনি পট্টনায়েকের মতো কঠোর মনোভাব দেখাতে পারেন, না-ও পারেন। শেষ অর্ডার থেকে বিচার শুরু হতে পারে। আবার নতুন করেও শুরুর সম্ভাবনা থাকছে।
কিন্তু সে সব পাত্তা না দিয়ে বুধবারের মহাযুদ্ধের পাল্টা স্ট্র্যাটেজি তৈরি করছেন আদিত্য। আমদানি করছেন তিন পাল্টা ওষুধ শ্রীনিকে আজীবন নির্বাসনে পাঠানো হোক, মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হোক সিবিআই বা এনআইএ-কে আর আইপিএলের অপারেশন রুল মেনে বহিষ্কার করা হোক চেন্নাই, রাজস্থান ও আইপিএল সিওও সুন্দর রামনকে। “কাল আদালতে আমার আইনজীবীরা বিষয়গুলো তুলবেন। তার পর দেখুন কী হয়,” গড়গড়িয়ে বলে যাচ্ছিলেন আদিত্য। প্রায় পিঠোপিঠি সময়ে আবু ধাবির শাহরুখ বলে চলেছেন, “আমি চাইব সব টিমেরই ভাল হোক। কিন্তু কেকেআরের যে আমি অন্ধ সমর্থক!”
সত্যি, কয়েকশো মাইলের তফাতে কত সহজে দুই পৃথিবী সৃষ্টি হয়ে যায়!