বিশ্বকাপে আফগান যোদ্ধা হামিদ। ছবি: এএফপি।
চওড়া হেডব্যান্ড। দু’গালে বড় বড় করে আঁকা জাতীয় পতাকায় অনেকটা সময়-সজ্জার ছোঁয়া। আর উইকেট নিলেই ছ’ফুট পাঁচ ইঞ্চির শরীরটাকে উল্টে ফেলে অপটু কার্টহুইল!
সব মিলিয়ে চলতি বিশ্বকাপে নিজের বোলিংয়ের জন্য যতটা, ততটাই মাঠে বর্ণময় উপস্থিতির জন্য নজর কাড়ছেন তিনি। বল হাতে আফগান-বাহিনীর সেরা সৈনিক। হামিদ হাসান।
হানাহানি আর যুদ্ধে দীর্ণ দেশের টিমটার আরও অনেকের মতোই ক্রিকেটের সঙ্গে হাসানের প্রগাঢ় প্রেমের পটভূমি সেই যুদ্ধই। যে যুদ্ধ ভিটেছাড়া করেছিল তাঁর পরিবারকে। আবার পৌঁছে দিয়েছিল ক্রিকেটের কাছে।
বছর একুশ আগের কথা। হাসানের বয়স তখন মাত্র ছয়। বোমা-গুলিতে উত্তাল জালালাবাদ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিল তাঁর পরিবার। শেষে আশ্রয় জোটে সীমান্ত পেরিয়ে প্রবাসে। পাকিস্তানের পেশোয়ারে, উদ্বাস্তু হয়ে। জীবন আচমকাই প্রচণ্ড কঠিন হয়ে ওঠে। কিন্তু তারই মধ্যে আলাপ হয় ক্রিকেটের সঙ্গে। ছিন্নমূল শিশুকে ক্রিকেট যেন দু’হাত বাড়িয়ে আপন করে নেয়। হাসানের কথায়, “ওখানে ১৫-১৬ বছর কাটিয়েছি। পড়তাম আফগান হাইস্কুলে। আর পাগলের মতো ক্রিকেট খেলতাম। বলতে পারেন ক্রিকেটের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।”
কিন্তু উপমহাদেশের জনপ্রিয়তম বলিউডি প্রেমকাহিনীতে যা হয়ে থাকে, সেটাই হল হাসানের ক্ষেত্রেও। প্রবল আপত্তি উঠল বাড়ি থেকে। বাবা-মা সটান বলে দিলেন, কোনও মতেই ক্রিকেট খেলা চলবে না! বলে দেওয়া হল, “সোজা পড়াশোনায় মন দাও!”
হামিদ হাসানের কথায়, “আমিও দমবার পাত্র নই। ক্রিকেট খেলবই। তাই বাড়ি থেকে যখন ক্রিকেট খেলা বন্ধ করে দেওয়া হল, লুকিয়ে খেলা শুরু করলাম। বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে, এ পাড়া ও পাড়ায় খেলতাম। কখনও ভাইদের সঙ্গেও।” এই করতে করতে ধরাও পড়ে যান। কিন্তু ক্রমশ ক্রিকেটের জন্য হাসানের আবেগ তাঁর বাবা-মায়ের মন জয় করে নেয়। তার পর বাড়ির উত্সাহেই বাকি পথ অতিক্রম করা।
সেই সব দিনের কথা বলতে গিয়ে হাসান বলেছেন, “আমার বড়দা ওই সময়টায় আমাকে ভীষণ সাহায্য করেছেন। আর মা সংসারের খরচ বাঁচিয়ে আমার জুতো, কিটসের পয়সা জোগাড় করতেন।”
ততদিনে নিজের উচ্চতা কাজে লাগিয়ে বলটা রীতিমতো ভাল করছেন ডানহাতি পেসার। ২০০৬-এ সেরা ব্রেকটা পান মুম্বইয়ে, মাইক গ্যাটিংয়ের নেতৃত্বে এক এমসিসি দলের বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ পেয়ে। পরে আফগান জাতীয় দলের হয়ে ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়ে কাউন্টির এক ম্যাচে তাঁর বাউন্সার সোজা গিয়ে লাগে মন্টি পানেসরের হেলমেটে। ঘটনাটা বিশাল কিছু না হলেও তার দৌলতে চর্চা শুরু হয় তাঁর গতি নিয়ে।
২০১২-য় হাঁচুর চোট ক্রিকেট থেকে প্রায় ছিটকে দিয়েছিল তাঁকে। হাসানের কথায়, “প্রচণ্ড খাটতে হয়েছে ফিটনেস ফিরে পেতে। বোলারের হাঁটু গেলে আবার ছন্দ ফিরে পাওয়া ভীষণ কঠিন হয়ে যায়। তবে আফগানিস্তানের মানুষ আর আমাদের ক্রিকেট বোর্ডও হাল ছাড়তে দেয়নি।”
কেউ যদি বলেন, তাতে আর বোলার কেমন কতটুকু বোঝা গেল, তাঁরা হাসানের আন্তর্জাতিক রেকর্ডে একবার চোখ রাখতে পারেন। ঝুলিতে ২৮টি একদিনের ম্যাচ খেলে ৫৩ উইকেট। এর চেয়ে কম ম্যাচে ৫০ উইইকেট রয়েছে আর শুধু শেন ওয়ার্ন আর ডেনিস লিলি-র। অনেকে বলবেন, হাসানের উইকেটের বেশির ভাগই তো অ্যাসোসিয়েট দেশগুলোর বিরুদ্ধে। কিন্তু চলতি বিশ্বকাপে তাঁর শিকার তালিকায় রয়েছে মাহেলা জয়বর্ধনে, কুমার সঙ্গকারার মতো মহাতারকার নাম।
তবে হাসান বলছেন, বিশ্বকাপে মাঠের বাইরের লড়াইটা তাঁদের আরও বেশি তাত্পর্যের। বলছেন, “আমরা একটা বার্তা পৃথিবীকে পৌঁছে দিতে চাই, যে ক্রিকেট দিয়ে আফগানিস্তানে পরিবর্তন আনতে পারি। বদলে দিতে পারি মানসিকতা। সে জন্যই মাঠে নেমে নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছি। যাতে বিশ্ববাসী দেখতে পায় আফগানরা শুধু যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটা জাতি নয়। আমাদের দেশেও প্রতিভার কোনও অভাব নেই!”