কাসিয়াসদের শোকের আগুনে পোড়ার ভয় পাচ্ছে এ বার ব্রাজিল

কুয়ের্মাস পেদির পার্দন আ তোডা নয়েস্ত্রা জেন্ত্রে! বিশ্বকাপের খেতাবরক্ষায় যেমন চ্যাম্পিয়নদের এটাই সর্বকালের নিকৃষ্টতম পারফরম্যান্স, তেমনই ওপরের স্প্যানিশ মন্তব্যের চেয়ে করুণতম সংলাপও বোধহয় বিশ্বকাপের চুরাশি বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন! “হে দেশবাসী, আপনাদের সবার মার্জনা ভিক্ষা করছি।”

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

সাও পাওলো শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৪ ০২:৪৬
Share:

চিলির ঝাঁঝে যেন চোখে জল স্প্যানিশ ফুটবলারদের। গ্যালারিতে উল্লাস চিলির দর্শকদের। সামনে স্পেনের রিজার্ভ বেঞ্চে তখন দিয়েগো কোস্তা, জেরার্ড পিকে, দাভিদ ভিয়ারা। ছবি: উৎপল সরকার

কুয়ের্মাস পেদির পার্দন আ তোডা নয়েস্ত্রা জেন্ত্রে!

Advertisement

বিশ্বকাপের খেতাবরক্ষায় যেমন চ্যাম্পিয়নদের এটাই সর্বকালের নিকৃষ্টতম পারফরম্যান্স, তেমনই ওপরের স্প্যানিশ মন্তব্যের চেয়ে করুণতম সংলাপও বোধহয় বিশ্বকাপের চুরাশি বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন!

“হে দেশবাসী, আপনাদের সবার মার্জনা ভিক্ষা করছি।”

Advertisement

বক্তা ইকার কাসিয়াস।

তিন সপ্তাহও হয়নি, লিসবনের ফাইনালে আটলেটিকো মাদ্রিদকে হারিয়ে উঠে এই কাসিয়াসই বলেছিলেন, বিশ্বকাপের চেয়ে অনেক বড় হল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। স্প্যানিশ আর্মাডা ব্রাজিল থেকে অস্ত যাওয়ার জন্য কাঠগড়ায় সবার আগে দাঁড়াতে বাধ্য হওয়া স্প্যানিশ গোলকিপারই বুঝিয়েছেন, অন্তত আবেগের তীব্রতা আর স্বপ্নের মাদকতায় দেশের সঙ্গে ক্লাব ফুটবলের তুলনাই হয় না!

একটা এত বড় ফুটবল সমাজের গাছ যখন ধরাশায়ী হয়, সে তো আর একা নিজে পড়ে না। প্রচণ্ড শব্দ করে আরও কিছু গাছ নিয়েই পড়ে! আয়োজক দেশেও তার মারাত্মক রেশ। যতই হোক না সেটা দূরবর্তী অন্য মহাদেশ। উরুগুয়ে-ইংল্যান্ড ম্যাচ কভার করতে এসেও দেখছি, এই দুটো টিমের কোনটা আজ টুর্নামেন্ট থেকে ইনিয়েস্তাদের পদানুসারী হবে, তা নিয়ে কোনও আলোচনা নেই। এরিনা কোরিন্থিয়ান্সের কফির তুফানে, বিয়ারের ফেনায় একচেটিয়া প্রসঙ্গ স্পেন!

মুখ ঢাকলেন হতাশায়। সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

সাও পাওলোয় বিকেলে ইংল্যান্ড খেলবে বলেই যেন সকাল থেকে শহরে প্রতীকী ইংল্যান্ড ওয়েদার। ঝিরঝির বৃষ্টি হঠাৎ তাপমাত্রা নামিয়ে দিয়েছে যে, হাফ নয়, ফুল সোয়েটার থাকলে ব্যাপারটা জুতের হয়। আলো জ্বলছে সকাল থেকে রাস্তায়। আর তাই বোধহয় আইল্যান্ড বোর্ডের নীচে আরও পরিষ্কার করে স্কোরটা ফুটে উঠেছে স্পেন ০ : চিলি ২। কালকের আর কোনও ম্যাচের স্কোর নেই। ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ জেতার পর ব্রাজিলের স্কোরটাও রাস্তার বিলবোর্ডে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। হঠাৎ স্পেন কেন? না কি এই জন্যই যে, এটা বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় ব্রেকিং নিউজ! একটা ছয় বছরের চ্যাম্পিয়ন টিম মাত্র তিন ঘণ্টার ফুটবল-চুল্লিতে ভস্মীভূত!

ব্রাজিলের এমনিতে কাসিয়াসদের শোকগাথায় আচ্ছন্ন থাকার কারণ ছিল না। স্পেন যাওয়া মানে তো একটা সম্ভাব্য বড় শত্রুর পতন। তাতে তো খুশি হওয়ারই কথা। তা ছাড়া রবেনদের কাছে স্পেন হেরে যাওয়ার পর যা দাঁড়িয়েছিল, তাতে গ্রুপ থেকে ব্রাজিল প্রথম হলে সেকেন্ড রাউন্ডে স্পেনকেই খেলতে হত। বাকি ফুটবল পৃথিবী যতই বলুক আগামী ১৩ জুলাই অবধি হ্যামলেট অভিনীত হবে কি না প্রিন্স অব ডেনমার্ককে বাদ দিয়েই, ব্রাজিল— স্কোলারির ব্রাজিলের সেই বিষণ্ণতার সরিক হওয়ার কোনও কারণ একেবারেই ছিল না।

অথচ কাল স্পেন ম্যাচ শেষ হওয়ার পর থেকে ব্রাজিলের রেডিও স্টেশন, টিভি চ্যানেল এমনকী স্টেডিয়ামেও ফোন করে অনুরাগীরা বলছে, ব্রাজিল সতর্ক হোক। এখনই শিক্ষা নিক স্পেন থেকে। নইলে বিপদ আসন্ন।

আচমকা এই ঠকঠকানি তৈরি হওয়ার কারণ ব্রাজিলের এ যাবৎ দুটো ম্যাচ খেলার কুৎসিত ধরন আর এ বারের বিশ্বকাপের প্যাটার্ন। প্রথম চার দিন বস্তা বস্তা গোল হওয়ার পর বলা হচ্ছিল, এটাই সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ। বোঝাচ্ছে কেন ফুটবলকে দ্য বিউটিফুল গেম বলা হয়! এখন ক্রমশ টুর্নামেন্ট এগনোর সঙ্গে মনে হচ্ছে, এটা সর্বকালের নির্দয়তম বিশ্বকাপ হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। যেখানে প্রতিপক্ষের ফুটবল-ঐতিহ্য বা র্যাঙ্কিংয়ের পরোয়া করছে না অনামীরা। কোস্টারিকা, চিলি, ক্রোয়েশিয়া— এরা এক-একটা মার্কামারা আন্ডারডগ টিম। অথচ তারাই দেখা যাচ্ছে, শিহরণ জাগিয়ে দিচ্ছে।

ব্রাজিলিয়ান রেডিওর সিনিয়র সাংবাদিক বলছিলেন, স্কোলারিকে ফোনে ধরার চেষ্টা করে পাচ্ছি না। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে আমাকে দেওয়া ইন্টারভিউয়ে উনি বলেছিলেন, “আর যে কোনও টিমকে সেকেন্ড রাউন্ডে খেলতে রাজি। কেবল চিলি যেন সামনে না পড়ে।” স্কোলারি মনে করেন, চিলিকে সামলানোর সবচেয়ে বড় সমস্যা, তারা অবিরত অ্যাটাক করে। নির্দিষ্ট কোনও প্যাটার্নে খেলে না। আর হারা-জেতা নিয়ে অত মাথা ঘামায় না বলে ভীষণ ফ্রি থাকে। ব্রাজিল কোচ নাকি বলেছিলেন, “স্পেন হোক, নেদারল্যান্ডস হোক, ওদের খেলাটা বুঝে প্ল্যান করা যায়। চিলির সঙ্গে করা কঠিন।”

সাংবাদিকটি এই জন্য স্কোলারিকে খুঁজছেন না যে, তাঁর ভবিষ্যৎ-দর্শন মিলে গিয়েছে। ওই গোল্ডম্যান স্যাক্স বা সিডনি ফরেনসিক অনুসন্ধানীদের কাপ পূর্বাভাসকে ধুলোয় মিশিয়ে। তিনি খুঁজছেন কারণ, ব্রাজিল গ্রুপ থেকে এক নম্বর হলে উল্টো দিকে চিলিই পড়বে!

পেলে ফোর্তালেজায় সে দিন ব্রাজিল ম্যাচের প্রথমার্ধটা মিস করেছেন ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে পড়ে। বলেছেন, “এই প্রথম হল বিশ্বকাপে ব্রাজিল খেলছে আর আমি মাঠে নেই।” তার পর আবার যোগ করেছেন, “যা শুনলাম তাতে অবশ্য খুব মিস করেছি বলে মনে হচ্ছে না।” তাঁর দেশবাসী যারা মাঠে ছিল তারাও প্রশ্ন তুলেছে, মাঠে থেকে কী পেলাম?

স্থানীয় টিভি চ্যানেলে রোমারিও নাকি বলেছেন, “যা খেলছে পুরোটাই তো নেইমার। যে দিন নেইমার আটকে যাবে, সে দিন ব্রাজিলকে কে দেখবে?” সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া, কাগজে লেখালেখি, চ্যানেলে বলা সব কিছু থেকে পরিষ্কার, কাঠগড়ায় সবার আগে পওলিনহো আর অস্কার। তার পরেই ফ্রেড। ব্রাজিলের গ্রুপটা অন্যগুলোর মাপে নিছকই সহজ। তবু দু’টো ম্যাচে ব্রাজিল গোলে মোট শট হয়েছে বারো বার। চার থেকে পাঁচটা সেভ করেছেন জুলিও সিজার। যা ব্রাজিলের বিশ্বকাপ ইতিহাসে অভূতপূর্ব। মাঝমাঠে বল স্ন্যাচ করার মতো কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। ডান দিক থেকেও যখন-তখন দানি আলভেজের সুনামের তোয়াক্কা না করে আক্রমণকারীরা চলে আসছে।

ব্রাজিল ফুটবল-জনতার স্পেনকে দেখে ভয় ধরে গিয়েছে, গ্রুপ লিগ থেকে না হয় বার হওয়া গেল। তার পর তো নকআউট। কেটা ছোট ভুলেই সেখানে ফুটবল-চুল্লিতে স্পেনের মতোই ঢুকে যাবে যাবতীয় স্বপ্ন। আর তার চেয়েও আতঙ্কিত জিজ্ঞাসা, যারা টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হবে বলে আমরা এত দিন ধরে শুনছি, শুনে বিশ্বাসও করছি, তাদের এখনই এত অনির্ভরযোগ্য লাগবে কেন?

ব্রাজিলীয় সাংবাদিকদের মুখে শুনছিলাম, এমনিতেও স্কোলারির এই ডিফেন্স শক্ত করে অ-ব্রাজিলীয় খেলার ধরণটা আমজনতার আত্মিক পছন্দ নয়। তাদের আত্মার সঙ্গে যায়, সাবেকি ব্রাজিল। বল ধরো, কাটাও, কাটিয়ে গোল করে এসো। এমনকী একটা সময় রিভেলিনহো-টোস্টাওরা পরামর্শও দিয়েছিলেন, স্পেনের অনুকরণে ব্রাজিল তিকিতাকা ধরুক।

এই সব প্রস্তাব আর সমালোচনা বদলে যায় গত বছর এমন দাপটের সঙ্গে কনফেড কাপ জেতায়। তখন থেকে সবাই স্কোলারির সাফল্যের কাছে মাথা নত করে বলতে থাকে, ঠিক আছে চ্যাম্পিয়ন যদি এতে হওয়া যায়, তা হলে এটাই সেরা মডেল। তাই ফুটবল-জনতার অপছন্দ তলায় তলায় ছিলই। এ বার দু’টো ম্যাচ দেখার পর আবার ওপরে উঠেছে। আর স্পেন বিদায় তার ওপর ছড়িয়েছে নতুন আতঙ্কের ভাইরাস।

প্রকাশ্যে অবশ্য টিমকে কেউ কোনও ক্ষোভ জানায়নি। স্কোলারি নিজেও অবিচলিত। ঘনিষ্ঠমহলে বলেছেন, “বিশ্বকাপ ম্যারাথন রেসের মতো। শুরুতেই বেশি ফুলকি দেখালে চলে না।” আগের দিন ম্যাচ ড্র করে ফেরার সময় ব্রাজিলের নীল রঙা টিম বাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে লোকে উৎসাহই দিয়েছে। হলুদ পতাকা আর জার্সি নাড়িয়েছে।

কিন্তু তখনও তো স্পেন ঘটেনি। ক্যামেরুন ম্যাচে আরও চারটে গোলে শট আর নিষ্ক্রিয় মাঝমাঠ দেখে বেরোলে ব্রাজিলীয় জনতার ধৈর্যের বাঁধ অক্ষুণ্ণ থাকবে তো?

মনে হচ্ছে না। বরং পরিস্থিতি সাময়িক ঠান্ডা করার জন্য তখন না থিয়াগো সিলভাদের কিছু বলতে-টলতে হয়। কাসিয়াসের সংলাপ না হলেও ওই দেশবাসী উদ্দেশ্য করেই বলা আর কী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন