বল দখলের যুদ্ধে বেঙ্গালুরুর কাছে রবিবার এ ভাবেই বারবার হারলেন ওডাফারা। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
বেঙ্গালুরু এফসি-২ (থই, রুনি)
মোহনবাগান-০
মাননীয় করিম বেঞ্চারিফা,
আমার শুভেচ্ছা নেবেন। প্রথমেই বলে রাখি আমি একজন আদ্যন্ত ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। জীবনে কোনও দিন মোহনবাগান গ্যালারিতে বসে ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতা ছিল না। রবিবার সেই অভিজ্ঞতা হল।
মাঠে যাওয়ার আগে তাই মনে একটা দোনোমোনো ছিলই। শেষমেশ বুক ঠুকে চলেই গেলাম। কেন জানি না, মনে পড়ল প্রথম জাতীয় লিগের কথা। সে বার মোহনবাগান টুর্নামেন্টে ছিল না। আপনার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট স্বপনসাধন বসু বিদেশ থেকে খেলে ফেরা চিমাকে পরের মরসুমের জন্য সবুজ-মেরুন জার্সি পরিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু বাংলার ফুটবলের কথা ভেবে সেই জাতীয় লিগে পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইস্টবেঙ্গলে খেলার জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলাম বাংলা ফুটবলের স্বার্থে এ দিন আপনারা সুনীল ছেত্রীদের বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে একটা লড়াকু ফুটবল উপহার দেবেন।
যুবভারতীর মিডল টিয়ারে বসে দেখলাম ভিআইপি গ্যালারিতে আমাদের সহকারী কোচ রঞ্জন চৌধুরী আর বিদেশি তারকা সুয়োকা তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে খেলা দেখতে এসেছেন। আপনার দল অবনমন প্রায় বাঁচিয়ে ফেলেছে। জানি, আপনি নিজেই এ দিন ম্যাচ শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, “আমাদের তো আর একটাই জয় চাই।” তার মানে আপনি কি আমাদের আই লিগ জয়ের পথ মসৃণ হোক চাননি এ দিন? এ-ও জানি, আপনি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, “এ সব যুক্তিহীন কথাবার্তা।”
কিন্তু সমর্থকের মন তো! অত যুক্তির ধার ধারে না। বাড়ি ফিরে পাড়ার আড্ডাতেও প্রশ্নটা কাউকে কাউকে তুলতে দেখলাম। আপনাদের তো হারানোর কিছুই ছিল না। তা হলে ৪-২-৩-১ ছকে ব্যাক ফোরের আগে দু’জন ডিফেন্সিভ ব্লকার ডেনসন আর জাকির কেন? বেঙ্গালুরুর পোক্ত চেহারার ব্রিটিশ রাইট উইঙ্গার শন রুনিকে আটকাতে লেফট ব্যাক শৌভিককে না দেখে অবাকই হলাম। ওর জায়গায় খেলতে নামা কিংশুকের দিক দিয়েই প্রথমার্ধ জুড়ে খেলাটা অপারেট করে গেলেন রুনি। প্রথম গোলটাও হল ওই দিক থেকে উড়ে আসা রুনির ক্রস থেকেই। ছোট্টখাট্টো চেহারার থই সিংহ যেখান থেকে গোল করতে ভুল করেননি।
ইংরেজ কোচ ওয়েস্টউডের বেঙ্গালুরু আক্রমণে আসছিল ৪-৩-৩ ছকে। কাউন্টার অ্যাটাকে আমাদের ক্লাবে খেলে যাওয়া লম্বা চেহারার রবিন সিংহকে মাঝখানে রেখে দুই উইং দিয়ে ক্রমাগত ক্রস রাখছিল আপনার সবুজ-মেরুন রক্ষণে। সুনীলদের আক্রমণটা শুরু হচ্ছিল ওদের সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার জন মেনিয়ঙ্গারের পা থেকে। বিপক্ষের সেই ‘মেনসুইচ’ আপনি তো বন্ধ করতে পারলেন না! তা হলে মিডল আর ডিফেন্সিভ থার্ডে দুই ব্লকার নিয়ে আপনার ছ’জন রক্ষণাত্মক ফুটবলারের ট্যাকটিক্স খাটল কোথায়?
আপনাদের আক্রমণের সময় বেঙ্গালুরু মাঝমাঠে লোক বাড়িয়ে হয়ে যাচ্ছিল ৪-৫-১। আপনার আক্রমণের স্ট্র্যাটেজি তো ওখানেই বোতলবন্দি। কারণ, দুই উইংয়ে পঙ্কজ মৌলা আর কাতসুমির কাছে বলই যাচ্ছিল না। আপনার দলের যত আক্রমণ মিডল করিডর দিয়ে। ডেনসনরা বল পেলেই হয় তুলে দিচ্ছিলেন ওডাফাকে লক্ষ করে, না হলে ক্রিস্টোফারের পায়ে। তিনি আবার দু’-একজনকে কাটিয়ে সেই ওডাফাকেই বল দিচ্ছিলেন। কিন্তু আপনার দলের অধিনায়ক এ দিন যে স্যান্ডউইচ হয়ে থাকলেন বেঙ্গালুরুর দুই বিদেশি স্টপার জন জনসন আর ওসানোর মাঝখানে! এক কালের গতি, টার্নিং সব কিছু হারিয়ে আপনার গোলমেশিন আজ অচল মুদ্রা! আপনিই তো রাম মালিককে এক সময় বলেছিলেন প্রতিভাবান। কানাঘুসো শুনলাম তিনি নাকি পুরো ফিট-ও। তা হলে আঠারো জনের দলে তরুণ প্রতিভাটা নেই কেন স্যর? গোটা ম্যাচে আপনি একবারও কেন আক্রমণাত্মক হলেন না? কাতসুমিকে মাঝখানে এনে সাবিথকে আনবেন ভাবছিলাম। কিন্তু আপনি নামালেন কিনা বিক্রমজিৎকে! বিপক্ষ কোচ লাল কার্ড দেখে গ্যালারিতে (কাঁচও ভেঙেছেন সেই রাগে), তাও আপনি আক্রমণাত্মক হলেন না!
খেলা শেষে তো একটা অন্য ব্যাপারও শুনলাম। প্রথম গোল খাওয়ার জন্য আপনি শিল্টনকে নাকি হাফটাইমে ড্রেসিংরুমে ধাক্কা মেরেছেন। সেখানই নাকি বলেছেন, শিল্টনের জন্যই প্রথম গোল খেতে হয়েছে! তাই দ্বিতীয়ার্ধে গোলে সন্দীপকে নামিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, “শিল্টনের চোট।” কিন্তু গ্যালারি থেকে তো প্রথম গোলটা দেখে মনে হল, ওই সময় আপনার দুই স্টপারই বরং ঠিক জায়গায় ছিলেন না। আপনি কোচ হয়ে গোলকিপারকে ধাক্কা মারছেন! বলেছেন, তিনি নাকি ইচ্ছে করে ডুবিয়েছেন! তা হলে কি নিজের দলের ড্রেসিংরুমের আস্থা আপনি হারিয়ে ফেলেছেন? এটা যদি সত্যি হয়, তা হলে আপনার পক্ষে তো মোটেও ভাল খবর নয়। আর পরিবর্ত নেমে সন্দীপও যে গোলটা হজম করেছেন রুনির পায়ে হাফভলি মারার বল তুলে দিয়ে, সেটাকে তা হলে কী বলবেন?
মুখ চুন করে তাই খেলা শেষে নামছিলাম গ্যালারি থেকে। পাশ দিয়ে নামছিলেন সুয়োকা আর ওর স্ত্রী সিজু। সুয়োকা দেখলাম টিভিকে বাইট দিচ্ছেন, “আমরা কারও উপর নির্ভর করছিলাম না। আমাদের বাকি চার ম্যাচ জিততেই হবে। তখন বেঙ্গালুরু একটা ড্র করলেই লিগ আমাদের।” সিজুও দেখলাম তাই বলছেন।
বাঙাল-রক্ত বোধহয় ওদের শিরাতেও ঢুকে গিয়েছে। শেষ সেকেন্ড অবধি লড়তে চান। যে মরণপণ লড়াইটা আমার প্রিয় ইস্টবেঙ্গল এ দিন আপনার দলের থেকে দেখতে চেয়েছিল! কিন্তু পেল কোথায়!
ইতি
জনৈক ইস্টবেঙ্গল সমর্থক