হে কলকাতা, বিদায়। ছবি: উৎপল সরকার
চোখের মণি থেকে চোখের বালি।
গোয়া থেকে কলকাতায় এসে ইস্টবেঙ্গল কোচ আর্মান্দো কোলাসোর এই পরিবর্তনে সময় লাগল মাত্র পনেরো মাস!
২৪ নভেম্বর, ২০১৩।
লালরিন্দিকার গোল ইস্টবেঙ্গল কর্তা ও জনতার কাছে চোখের মণি বানিয়ে দিয়েছিল আর্মান্দো কোলাসোকে। ডার্বি জয়ের প্রথম স্বাদ পেয়ে সেদিন স্টেডিয়ামের ট্র্যাকে হাঁটু মুড়ে দু’হাত তুলে কলকাতা ময়দানের প্রথম গোয়ান কোচ বলেছিলেন, “ইস্টবেঙ্গলকে দেশের সফল ক্লাব বানাতেই তো এখানে আসা। কলকাতায় আমার এত বন্ধু আছে জানতাম না।” পাশে সে দিন তাঁকে ঘিরে ছিলেন লাল-হলুদ কর্তারা। গোয়ার বাড়ি থেকে ঘনঘন আসছে স্ত্রী জুলিয়ানার ফোন। শুভেচ্ছার প্লাবন। কোচের মুখে সে দিনের হাইভোল্টেজ হাসি ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের নিঃসন্দেহে এখনও মনে আছে।
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫।
যুবভারতীর এ দিনের ডার্বিতেও ম্যাচের সেরা সেই লালরিন্দিকা। এ বারও অপরাজিত আর্মান্দো। জিতলেন না। হারলেনও না। তবু অমাবস্যার নিকষ অন্ধকার গোয়ান কোচের চোখমুখে। ময়দানি জল্পনা সত্যি হলে, চলে যাচ্ছেন যে।
মঙ্গলবারের আর্মান্দো বিপক্ষ কোচ থেকে ফুটবলার, নিজের সহকারী থেকে র্যান্টি-বলজিৎসবার সঙ্গে হাত মেলালেও পাশে দেখতে পেলেন না ক্লাবের কোনও শীর্ষ কর্তাকে। বিমর্ষ মনে ড্রেসিংরুমে যাওয়ার পথে বলে ফেললেন, “কলকাতায় আমার কোনও বন্ধু নেই!” তার পর যা বললেন তা শুনলে মনে হবে সুব্রত ভট্টাচার্যের মোবাইলের কলার টিউনটা বাজছে, “...সুখে সে রয়েছে সুখে সে থাকুক, মোর কথা তাঁরে বোলো না বোলো না।” আর্মান্দোও যে ঠিক সে ভাবেই বলে গেলেন, “নতুন কোচ তো আসছে ভাই। আর আমার সঙ্গে কথা কেন? ইস্টবেঙ্গল এগিয়ে যাক।”
পনেরোটা মাসে কত কিছু পাল্টে যায়!
কলকাতায় জীবনের প্রথম ডার্বিতে নামার দিন ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দিয়েছিলেন, “নিজের প্রতি আস্থা বাড়াও। ম্যাচটা জিতে ফিরো।” শোনা গেল, মঙ্গলবার সে সব আর কিছু লেখেননি। বদলে তাঁর দলের কাউকে কাউকে বলেছিলেন, “চলেই তো যাচ্ছি। স্রেফ আমার জন্য খেলে দাও। যেন হেরে কলকাতা ছাড়তে না হয় সেই উপহারটা অন্তত দিও!” এ দিন ডার্বি শেষে সে জন্যই বোধহয় ছাত্রদের অকুণ্ঠ প্রশংসার ঝর্ণা তাঁর গলায়। “৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে দু’টো ম্যাচে খাবরারা যে ভাবে লড়ল তাতে ওদের ধন্যবাদ দিতেই হবে।”
স্বাাভাবিক। ছাত্ররা সম্মান বাঁচালেন যে।
সরকারি ভাবে এখনও ঘোষণা নেই। কিন্তু ময়দানে ‘ওপেন সিক্রেট’, ১৭ ফেব্রুয়ারিতেই লাল-হলুদ জীবন অতীত হয়ে গেল আর্মান্দো কোলাসোর। ইস্টবেঙ্গল কর্তারা স্পষ্ট করছেন না। ঢাকগুড়গুড় চলছে। আর্মান্দোর বদলি সতৌরি এসে গিয়েছেন কি না প্রশ্নে ফুটবল সচিব সন্তোষ ভট্টাচার্য বিস্মিত, “আমি তো এ সব কিছুই জানি না!”
কিন্তু আর্মান্দো জানেন। বলছেনও। “আজ মাঠে আসার আগে একটা এসএমএস পেলাম। আমার উত্তরসূরী না কি শহরে চলে এসেছে। জানি না ক্লাব আমাকে আর রাখবে কি না। তবে এ রকম পরিস্থিতিতে কখনও পরিনি। ভারতীয় কোচেদের ভাগ্যটাই এ রকম।” বলে একটু থামলেন গোয়ান কোচ। তার পর ফের বললেন, “আর্মান্দো কোলাসো কিন্তু এত সহজে শেষ হয়ে যাবে না। জল ছাড়া যেমন মাছ বাঁচে না। আমিও ফুটবল ছাড়া বাঁচব না। কোথাও না কোথাও বাচ্চাদের খেলা শেখাব। মনে রাখবেন, একটা দরজা বন্ধ হলে আর একটা দরজা খুলে যায়।”
কী মনে হল, একবার দেখে নিলেন তার পর চার দিকে। এ বার যেন অভিমান ফুটে বেরোয় ক্ষণিক, “আসলে এখানে জিতলেই সেরা। হারলেই শেষ। কলকাতার বন্ধুরা মনে রাখবেন কোচরাও মানুষ। তাঁদের এ ভাবে চাপে ফেলবেন না। তা হলেই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল-মহমেডানের ফের জয়জয়কার শুরু হবে।” কবে ফিরে যাচ্ছেন? হতাশাবিদ্ধ আর্মান্দো কোনও রকমে উত্তর দেন, ““২-৩ দিন দেখি। তার পর সব জানাব।”
আর জানানো! ফুটবলাররা জানতে চেয়েছিলেন ড্রেসিংরুমে, কোচ, পরের প্র্যাকটিস কবে? আর্মান্দো নাকি বলে দেন, ক্লাব ম্যানেজমেন্ট জানিয়ে দেবে। যিনি এখনও মনে করেন, এই ইস্টবেঙ্গল পারবে আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হতে। পারবে, সেন্ট্রাল মিডফিল্ডটা একবার সাজিয়ে নিলে।
উত্তরসুরি নেবেন কি না, পরের প্রশ্ন। বিদায়বেলার আর্মান্দো অন্তত তাঁর শেষ প্রেসক্রিপশনটা দিয়ে গেলেন ক্লাবকে।