নিজের ‘ল্যাবরেটরিতে’ দ্য স্পেশ্যাল ওয়ান। ছবি: এএফপি
এক সপ্তাহ আগে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালের এই ম্যাচটার প্রথম পর্ব দেখার পর লিখেছিলাম, স্রেফ মোরিনহোর জন্যই স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে দ্বিতীয় পর্বের ম্যাচে চেলসিকে এগিয়ে রাখছি। বুধবার চেলসির ঘরের মাঠে আমার বাজি চেলসি।
ভুলে যাবেন না দিয়েগো সিমিওনের আটলেটিকো মাদ্রিদ এ মরসুমে চমৎকার ফর্মে রয়েছে। গত সপ্তাহেও আটলেটিকোর ঘরের মাঠ ভিসেন্তে কালদেরনে দিয়েগো কোস্তাদের খেলা আদৌ অনুজ্জ্বল ছিল না। ছোট ছোট পাসে উইং নির্ভর ফুটবল খেলেছিল স্প্যানিশ দলটা। চেলসির তুলনায় মাঝমাঠে বলের দখল কিংবা পাসিংয়ে এগিয়ে থাকলেও ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ‘ব্লু আর্মি’-র রক্ষণে অবশ্য দাঁত ফোটাতে পারেনি সে দিন আটলেটিকো।
কেন?
চেলসির পর্তুগিজ ফুটবল কোচ হোসে মোরিনহোর ‘আল্ট্রা ডিফেন্সিভ’ ফুটবলের জন্যই গোল করার রাস্তা খুঁজে পায়নি সিমিওনের ছেলেরা। ম্যাচ শেষ হয়েছিল গোলশূন্য ভাবে।
বিশ্ব ফুটবলের খবরাখবর যাঁরা রাখেন তাঁরা জানেন, এটাই হল মোরিনহো-ম্যাজিক। নিজের প্রতি অসম্ভব আস্থা। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য মগজে বিস্তর পরিকল্পনা গিজগিজ করে। বিপক্ষকে মিনিট দশ-পনেরো দেখেই ‘অ্যান্টিডোট’ বার করে ফেলাটা সহজাত এই পর্তুগিজ কোচের। উপস্থিত বুদ্ধি, চটজলদি সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যই ফুটবল মহলে মোরিনহো ‘দ্য স্পেশ্যাল ওয়ান’। জানি, অনেকেই এই প্রসঙ্গে ওঁর হঠাৎ-হঠাৎ মাথা গরম করে আলটপকা মন্তব্যের বিষয়টা টানবেন। কিন্তু আমি বলব, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস কখনও চিড় খায় না বলেই মোরিনহো ওই রকম। মুখেও যেমন বলেন, ট্রফি এনেও তেমন দেখিয়ে দেন। যার সুবাদে রাইকার্ডকে পর্যন্ত বলে দিতে পারেন, “উনি বড় ফুটবলার হতে পারেন। কিন্তু ট্রফি কোথায়? আমার হাতে ট্রফি রয়েছে।” মোরিনহো কোচিং কেরিয়ার শুরু করেছিলেন বিখ্যাত ইংরেজ ফুটবল ম্যানেজার স্যর ববি রবসনের অনুবাদক হয়ে। কোচিংয়ের প্রথম পাঠটা রবসনের মতো গুরুর হাতে হওয়ায় তাই মগজাস্ত্রের অভাব নেই।
মোরিনহোর ‘আল্ট্রা ডিফেন্সিভ’ ফুটবলের জন্য দুনিয়া জুড়ে অনেক সমালোচনা। কুৎসিত রক্ষণাত্মক ফুটবলের জন্য বারবার কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে মোরিনহোকে। বলা হয় থাকে, এই ফুটবল চলবে না। কিন্তু আমি বলব, এই পর্তুগিজ কোচকে ভুলও বোঝা হয় অনেক ক্ষেত্রে। ওঁর দল তো প্রতি-আক্রমণে গিয়ে গোলও করে আসছে। রক্ষণের সঙ্গে আক্রমণের এই মিশেলটাই মোরিনহোর ইউএসপি। দু’দিন আগেই লিভারপুলের বিরুদ্ধে জেদ ধরে বেশির ভাগ প্রথম সারির ফুটবলারকে বাদ দিয়েই তো ম্যাচ বার করে নিলেন ২-০। গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো করার মতোই মোরিনহোর কথা ধার করেই বলতে হয়, কখনও কখনও এই পৃথিবীতে অনেক সুন্দর মানুষ দেখা যায় যাঁরা বুদ্ধিহীন। কিন্তু অনেক বিজ্ঞানী রয়েছেন যারা মোটেও সুন্দর দেখতে নয়। মোরিনহোর দলের ফুটবলটাও সে রকম। দেখতে সুন্দর না হলেও সৃষ্টিশীল। ফলদায়ক।
আটলাটিকো বোমা দি’কোস্তা
ফুটবল বিজ্ঞানী মোরিনহো যেন ধ্বংসের পাশাপাশি সৃষ্টিও করে চলেছেন। মোরিনহোর ধ্বংসাত্মক ফুটবল নিয়ে এত চর্চার মাঝে ব্রাজিল-জাত পর্তুগিজ ফুটবলার ডেকোর কথা তাই মনে পড়ছে। “পোর্তো কখনও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে পারে, এই ভাবনা স্বপ্নেও ছিল না। কিন্তু মোরিনহো সেটা শুধু ভাবতেই শেখাননি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ পোর্তোকে জিতিয়েওছিলেন।” এটাই হল মোরিনহো। বার্সায় মেসি-জাভি-ইনিয়েস্তারা যখন অদম্য গতিতে এগোচ্ছিল, তখন মোরিনহোই একমাত্র কোচ যিনি মাথা খাটিয়ে বার করেছিলেন, নিজের জোনে ট্যাকল করার থিওরি। যা বেশ কয়েক বার আটকে দিয়েছিল তিকিতাকাকে। আজ যে থিওরি নিচ্ছেন অনেক কোচই।
আটলেটিকো-চেলসি প্রিভিউ লেখার জন্য ইংল্যান্ডের সংবাদপত্র ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে দেখলাম, ফের একটা বোমা ফাটিয়েছেন ফুটবল দুনিয়ার ‘দ্য স্পেশ্যাল ওয়ান’। সেই সত্তর-আশির দশকে প্রদীপদা, অমলদারা যে রকম করতেন মাঠে নামার আগে, অনেকটা সে রকম ভাবেই প্রতিপক্ষ কোচ সিমিওনেকে চমকে দিয়েছেন মোরিনহো। আটলেটিকোর হোম ম্যাচে চোট পেয়ে উঠে যাওয়া জন টেরি, পের চেক, হ্যাজার্ড, এটো সবাইকে চনমনে মেজাজে প্র্যাকটিস করিয়ে। যার মানে টেরি-চেকরা ঘরের মাঠে খেলার জন্য হয়তো তৈরি। বোঝাই যাচ্ছে চোট অতটা বড় ছিল না। ওদের তিন মাস মাঠের বাইরে থাকার ধোঁয়াশা সৃষ্টি করাটা মোরিনহোরই মস্তিষ্কপ্রসূত। ফর্মে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বী আটলেটিকোকে লন্ডনে পা দেওয়ার পরে চমকে দেওয়ার জন্য চেলসি কোচের ‘দ্য স্পেশ্যাল মাইন্ডগেম’!
যদিও আমার ধারণা, এটা শুধুই চাল। ম্যাচে হয়তো মার্ক শোয়ারজারকেই শেষ পর্যন্ত গোলে খেলাবেন চেলসি কোচ। তবে এটো, টেরি, হ্যাজার্ডদের খেলিয়ে দেবেন বলেই মন বলছে। কারণ লিসবনে ফাইনাল খেলতে হলে চেলসিকে কিন্তু গোল করতে হবে বুধবার রাতে। তাই তোরেসের সঙ্গে এটোকে এনে স্ট্রাইকিং ফোর্সে শক্তি বাড়াবেন মোরিনহো। ল্যাম্পার্ড, মিকেলরা নেই। তবে ও সবে কাবু হওয়ার বান্দা মোরিনহো নন।