এ বার সেমিফাইনাল: দুই পেসারের সঙ্গে উচ্ছ্বসিত বাংলা অধিনায়ক। মঙ্গলবার ইডেনে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
গলার টুঁটি চেপে চিৎকার করছেন লক্ষ্মীরতন শুক্ল। নিচু হতে হতে প্রায় বসে পড়ছেন বাইশ গজে, ইয়ো মহেশের কট বিহাইন্ড নিয়ে আম্পায়ারের বিশ্বাস জিততে বারবার চিৎকার, ‘মা কসম, মা কসম, আউট হ্যায়!’ আবেদনে কান না দিয়ে তর্জনী তুলে বঙ্গ অধিনায়ককে ফিরে আসতে বললেন আম্পায়ার।
মুহূর্তে চোখমুখের ভূগোল বদল। ক্ষিপ্ত হুঙ্কার, শাপ-শাপান্ত, অসন্তোষ প্রদর্শন!
এম মহম্মদের স্টাম্পটা গুঁড়িয়ে অদ্ভুত কায়দায় হাঁটতে শুরু করলেন অশোক দিন্দা। শরীরীভাষার সারমর্ম এ আর এমন কী! কিন্তু অশোক দিন্দা তো, আবেগ আটকে থাকে কতক্ষণ? আধ সেকেন্ডের মধ্যে পর পর ফিস্ট পাম্প।
এক...দুই...তিন!
শেষ উইকেটটা তুলে ব্যাটসম্যানের দিকে তাকালেনও না মহম্মদ শামি। মাথা নিচু করে ওখানেই হ্যান্ডশেক, সতীর্থরা ততক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন জাতীয় দলের বঙ্গ পেসারের উপর। আনন্দ বা দুঃখ, কোনও দিনই বিশেষ প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না শামির থেকে। শুধু উইকেটটা ঠিকঠাক পাওয়া যায়।
আজ যেমন। ইয়ো মহেশের চার উইকেটের জবাব তাঁর চার!
ক্লাবহাউস গেট দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রের মতো বেরিয়ে আসছেন অশোক মলহোত্র। কী কুক্ষণে অপেক্ষারত এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, ভাবতে পেরেছিলেন ১৬৭ তুলে এত বড় ব্যবধানে জিতবেন? গরগরে উত্তর এল, “আপনি ভাবতে পারেননি। আমরা ভাবতে পেরেছিলাম!”
ইনি কে! আটান্ন বছরের কোচ অশোক? নাকি উনত্রিশের ক্রিকেটার অশোক? ক্রিকেটমহলে যিনি পরিচিত ছিলেন ‘বিখ্যাত’ মেজাজের জন্য?
রাত ন’টা। বাংলা ক্রিকেটারদের কেউ কেউ বেরনোর সময় তাকাচ্ছেন ইডেনের ‘ভিজিটার্স ড্রেসিংরুমে’র দিকে। বিজয়-অশ্বিনরা টিম বাসে উঠে পড়লেন, ম্যাচ শেষে প্রথাগত করমর্দন-পর্বেও তো তাঁকে দেখা গেল না। বাংলার এক নির্বাচক শ্লেষাত্মক সুরে বলে গেলেন, “যা লোক, এতক্ষণ কি আর বসে আছে?”
সত্যিই তো। ডব্লিউ ভি রামনতিনি গেলেন কোথায়?
পূর্বতন কোচকে ছাত্রদের প্রবল খোঁজাখুঁজিতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আজকেরটা ধরলে চলতি মরসুমে দু’বার। রঞ্জির পর বিজয় হাজারে, চিপকের পর ইডেন, চেন্নাইয়ের পর বাংলা, র্যাঙ্ক টার্নারের পর গ্রিন টপ, দু-দু’বার মহানাটকীয় যুদ্ধ এবং দু’বারই এক পরিণতি।
টিম রামন ‘রক্তাক্ত’।
মাস দুয়েকের মধ্যে দু’টো ম্যাচে তফাত হচ্ছে, নববর্ষের দিন বাংলা জিতেছিল স্পিন-সম্মোহনে। উঠেছিল রঞ্জি কোয়ার্টার ফাইনালে। আর আজ জিতল পেস-পরাক্রমে। উঠল বিজয় হাজারে সেমিফাইনালে। সে দিন সৌরাশিস লাহিড়ী একাই নিয়েছিলেন সাতটা। আজ দিন্দা-শামি মিলে সাতটা।
মহম্মদ শামি ৮.৫-০-২৫-৪।
অশোদ দিন্দা ৯-৪-১৩-৩।
বাংলা ইনিংসের শেষের সময় এই বোলিং হিসেব যদি ইডেনে উপস্থিত হাজার পাঁচেক দর্শককে দেখানো হত, তা সাম্প্রতিকের বিমান-নিখোঁজ রহস্যের চেয়ে কম অলৌকিক লাগত না! ১৬৭ হাতে নিয়ে বাংলা কেন, কে কবে শেষ বিজয়-বদ্রিনাথ-দীনেশ কার্তিক-বাবা অপরাজিতের ব্যাটিংয়ের বিরুদ্ধে জিতেছে, সেটাও ৭৭ রানে, সন্দেহ আছে। সেখানে দিন্দার ভয়াবহ আউটসুইঙ্গার এবং শামির মারাত্মক ‘অফ দ্য সিম মুভমেন্টে’র প্রকোপে পড়ে দশ ওভারের মধ্যে অর্ধেক তামিলনাড়ু ব্যাটিং ‘বাপি বাড়ি যা’, স্কোরশিট দেখে মনে হল দিব্য তা দিয়ে গাড়ির নাম্বারপ্লেট তৈরি হয়।
প্রথম ওভারেই দিন্দার আউটসুইংয়ে অনিরুদ্ধ শ্রীকান্ত স্লিপে, দু’ওভার পরে শামির বল কাট করে ভিতরে ঢুকে অপরাজিতকে বুঝিয়ে দিল, অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন টিমের প্রতিনিধিত্ব করা আর দেশের সেরা পেসারকে খেলা এক জিনিস নয়। মুরলী বিজয় যিনি ভারতের হয়ে টেস্টে ওপেন করেন, তাঁকে পর্যন্ত দেখে মনে হল ইডেনে শামি-দিন্দার পেস বোলিং নয়, গ্রাস কোর্টে ফেডেরারের টানা ‘এস’-এর সামনে ফেলে দেওয়া হয়েছে! বিজয়ের রানটা চাই? ৮৫ বলে ২৪। স্ট্রাইকরেট ২৮। মনে রাখা ভাল, ইনি আইপিএল খেলেন। নিলামে দরটাও বেশ ভাল ওঠে খুনে ব্যাটিংয়ের জন্য।
ইডেন উইকেট নিশ্চয়ই আজ শামিদের প্রবল সাহায্য করেছে। শামির এক-একটা বল কাঁধের উপর থেকে ধরতে হয়েছে ঋদ্ধিমান সাহাকে। উইকেট দেখে সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে হয়েছে, ‘চোখ বন্ধ করলে পারথ, খুললে ইডেন’। কিন্তু ১-১, ৩-১৮, ৫-২৫, ৭-৬২ থেকে ৯০ অলআউট স্রেফ উপযোগী পিচ দিয়ে হয় না। লাইন-লেংথটাও লাগে। শামি জাতীয় দলে খেলেন, তিনটে ফর্ম্যাটেই তাঁকে ছাড়া বোলিং ভাবা যায় না। কিন্তু দিন্দা? জাতীয় নির্বাচকদের তো ইডেনে বসে বসে গিলতে হল টানা উপেক্ষার উত্তর।
তাই মঙ্গলবারের ইডেনে দিন্দা-লক্ষ্মীদের তীব্র প্রতিক্রিয়ার নিশানায় বোধহয় কখনও রামনের তামিলনাড়ু, কখনও জাতীয় নির্বাচককুল। প্রাক্তন গুরুর টিমকে বারবার বধ করে যতটা সুখ, ততটাই বোধহয় নির্বাচকদের সামনে পারফর্ম করার সশব্দ কষাঘাতে। বাংলা সেমিফাইনাল জিতবে কি না জানা নেই। ব্যাটিংয়ের জঘন্য বিজ্ঞাপন পাল্টাতে হবে। শ্রীবৎস গোস্বামী বা সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের আউট হওয়ার ধরন নিন্দনীয়। মনোজ তিওয়ারি, ঋদ্ধিমান বা লক্ষ্মীকেও বুঝতে হবে, শামি আর নেই। দিন্দারও এক দিন খারাপ যেতে পারে। তবু কোথাও গিয়ে সে সব ভুলে আজ মনে রাখা যায় কিছু ফ্রেম।
অশ্বিনকে স্টেপ আউট করে মনোজের ফেলে দেওয়া। মাঠের তর্জন-গর্জন দেখে টিভি রুম থেকে লক্ষ্মীর নামের পাশে ‘ইমোশনালি অ্যানিমেটেড’ শব্দবন্ধ জুড়ে দেওয়া। শামি-দিন্দার পেস-চুল্লিতে টিম রামনের ‘দাহ’। বা বঙ্গ অধিনায়কের ম্যাচ শেষে সহাস্যে বলে যাওয়া, ‘‘ইয়ে তো প্যার মহব্বত কা ম্যাচ থা!”
লক্ষ্মী জানতেন না, যাঁর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলা তিনি বিকেল পাঁচটায় ইডেন ছেড়েছেন। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে চেন্নাইয়ের ফ্লাইট ধরতে রওনা হয়ে যান রামন। তামিলনাড়ু যে এ ভাবে হেরেছে, খবর পেয়েছেন পরে। লক্ষ্মীদের অদৃশ্য মেসেজটাও বোধহয় তখনই ইনবক্সে ঢুকেছে।
‘টু স্যর, উইথ লাভ’!
বাংলা
তামিলনাড়ু
জয়জিৎ ক কার্তিক বো মহেশ ৫
শ্রীবৎস ক রাহিল বো মহম্মদ ২২
সুদীপ বো মহেশ ৪, মনোজ বো মহেশ ২৫
ঋদ্ধিমান এলবিডব্লু মহেশ ১
লক্ষ্মীরতন বো শঙ্কর ৩০
সায়ন ক অপরাজিত বো রাহিল ৬
সৌরাশিস বো রাহিল ৩২
বীরপ্রতাপ স্টাম্প কার্তিক বো অশ্বিন ১০
শামি এলবিডব্লু অশ্বিন ০
দিন্দা ন.আ ২১
অতিরিক্ত ১১
মোট ৪২.১ ওভারে ১৬৭।
পতন: ৮, ২৪, ৬২, ৬৩, ৬৯, ৯৫, ১১১, ১২৯, ১৩৯, ১৬৭।
বোলিং: বালাজি ৯-০-৪৭-০, মহেশ ৮-০-২৩-৪, মহম্মদ ৭-১-২২-১, অশ্বিন ৯-১-৩৮-২, রাহিল ৫.১-০-১৮-২, শঙ্কর ৪-০-১৭-১।
বিজয় ক সায়ন বো বীরপ্রতাপ ২৪
অনিরুদ্ধ ক সুদীপ বো দিন্দা ০
অপরাজিত এলবিডব্লু শামি ১২
বদ্রীনাথ ক ও বো মহম্মদ শামি ০
কার্তিক ক ঋদ্ধি বো দিন্দা ৫
অশ্বিন এলবিডব্লু শামি ০
শঙ্কর ক সুদীপ বো বীরপ্রতাপ ৬
মহেশ ক সুদীপ বো লক্ষ্মীরতন ১
বালাজি ক সুদীপ বো শামি ১০
মহম্মদ বো দিন্দা ১৪, রাহিল ন.আ ২
অতিরিক্ত ১৬
মোট ৩৩.৫ ওভারে ৯০।
পতন: ১, ১৬, ১৮, ২৩, ২৫, ৫৫, ৬২, ৬৩, ৮২, ৯০।
বোলিং: দিন্দা ৯-৪-১৩-৩, শামি ৮.৫-০-২৫-৪, বীরপ্রতাপ ৮-১-১৮-২, লক্ষ্মীরতন ৮-২-৩০-১।
বুধবারে বিজয় হাজারে ট্রফি
পঞ্জাব বনাম রেলওয়েজ (ইডেন, ১-৩০)
ঝাড়খণ্ড বনাম সার্ভিসেস (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ, সল্টলেক ৮-৪৫)
ইডেনে বাংলার স্মরণীয় জয়
রঞ্জি কোয়ার্টার ফাইনাল বনাম হায়দরাবাদ (২২-২৫ ফেব্রুয়ারি ’৬৩)
বাংলা ৩৮৬ (পঙ্কজ রায় ১১২, রয় গিলক্রিস্ট ৫-১২৪) ও ২৮০ (পঙ্কজ ১১৮, গিলক্রিস্ট ৪-১১১)
হায়দরাবাদ ৩৬১ (লেস্টার কিং ৫-১৪৬, দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায় ২-৮৮, চুনী গোস্বামী ২-২৩) ও ১২১ (দুর্গাশঙ্কর ৪-২৩)
বাংলা ১৮৪ রানে জয়ী (৮ বলের ওভার)
রঞ্জি সেমিফাইনাল বনাম তামিলনাড়ু (৩-৬ মার্চ ’৮৯)
বাংলা ৫৯৬-৮ ডিঃ (সম্বরণ ১৪০, রাজিন্দর সিংহ ১৪৮) ও ৭৬-১
তামিলনাড়ু ৫৩৫ (রামন ২৩৮, গৌতম সোম (জুনিয়র) ৪-১৩৫, সাগরময় ২-৬৯, দত্তাত্রেয় ২-৯২)
বাংলা প্রথম ইনিংস লিডে জয়ী
রঞ্জি ফাইনাল বনাম দিল্লি (২৩-২৮ মার্চ, ’৯০)
দিল্লি ২৭৮ (রাজীব শেঠ ৩-৭৩, দত্তাত্রেয় ৩-৭৪)
বাংলা ২১৬-৪ (অরুণ লাল ৫২ নঃআঃ)
বাংলা রান কোশেন্টে (৩.৩৯-২.৭৬) জয়ী
রঞ্জি কোঃ ফাইনাল বনাম কর্নাটক (১৬-২০ ফেব্রুয়ারি ’৯১)
কর্নাটক ৭৯১-৬ ডিঃ (অর্জুন রাজা ২৬৭, দ্রাবিড় ১৩৪, কিরমানি ১১২)
বাংলা ৬৫২-৯ (শ্রীকান্ত কল্যাণী ২৬০, স্নেহাশিস ১১৬ নঃআঃ, সাগরময় ১০ নঃআঃ, শ্রীনাথ ৪-৯৮, বেঙ্কটেশ প্রসাদ ৩-১১৯, কুম্বলে ২-২১৫)
বাংলাকে রান কোশেন্টে জেতায় শেষ উইকেট জুটি