আটলেটিকো ১ (মহম্মদ রফিক)
কেরল ব্লাস্টার্স ০
লর্ডসের সেই জামা খুলে ওড়ানোর দৃশ্যটা মনে পড়ছিল! ডি ওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় দু’হাত আকাশের দিকে ছোড়ার সময়। তাঁকে তখন ছুঁতে চাইছেন উচ্ছ্বসিত লিয়েন্ডার পেজ। লাফিয়ে উঠেই হঠাত্ থেমে গেলেন প্রিন্স অব ক্যালকাটা। তার পর জড়িয়ে ধরলেন মেয়ে সানাকে।
অন্যতম টিম মালিক গ্যালারি থেকে মাঠে নেমে আসার আগেই অবশ্য জোড়া নাচ শুরু হয়ে গিয়েছে কলকাতার আটলেটিকো সংসারে। কোচ আন্তোনিও হাবাসকে ঘিরে নাচছেন দলের স্প্যানিশ ফুটবলাররা। অন্য নাচটা মহম্মদ রফিককে নিয়ে। সেখানে তখন অর্ণব-বলজিত্রা।
ফাইনালের শেষ ষোলো মিনিট আগে পরিবর্ত নেমে ইনজুরি টাইমের তিরিশ সেকেন্ড থাকতে গোল করে কলকাতাকে যিনি প্রথম আইএসএলে চ্যাম্পিয়ন করলেন। সোদপুরের বঙ্গসন্তানের টুর্নামেন্টে যেটা ছিল মাত্র দ্বিতীয় ম্যাচ!
সচিন তেন্ডুলকরের পাড়ায় এসে ‘দাদাগিরি’ করে ট্রফি জিতে নেওয়া। সৌরভ এ জন্য প্রধান কৃতিত্ব দিতেই পারেন কোচ হাবাসকে। ভারত অধিনায়ক হিসাবে সৌরভের মনোভাবের ছোঁয়ায় কি না বোঝা গেল না, তবে মহারাজের মতোই সত্যিই বুকের পাটা আছে দেখিয়ে দিলেন হাবাস। ভারতীয় ক্রিকেটের খুব খারাপ সময় জাহির-যুবরাজ-হরভজন-সহবাগের মতো একঝাঁক তরুণ মুখকে তাঁর টিম ইন্ডিয়ায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলি।
হাবাসও দেখালেন তাঁকে নিয়ে যত সমালোচনাই টিমের বাইরে-ভিতরে হোক সাফল্যই যে সব সমালোচনার শ্রেষ্ঠ জবাব সেটা দেখানোর কেরামতিও জানেন তিনি।
টিমের সবচেয়ে সফল স্ট্রাইকার ফিকরুকে ফাইনালের আগে কিনা বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন! টিমের মার্কি ফুটবলার লুই গার্সিয়াকে ফাইনালের প্রথম দলেই রাখেননি। মোক্ষম চাল দিলেন মহম্মদ রফিকে বসিয়ে রফিককে নামিয়ে। সাইডলাইনে চিত্কার করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাও দমেননি স্প্যানিশ কোচ। ১৬ ম্যাচের মধ্যে ন’টা ড্র। তার পরেও চ্যাম্পিয়ন। ভাবা যায়! এমনটাও তা হলে হয়!
অনেক ‘নেই’-এর শহর কলকাতায় একই মরসুমে দেশের সবচেয়ে গ্ল্যামারাস ক্রিকেট আর ফুটবলের দু’টো ট্রফি এসে গেল। যা নিয়ে মহা গর্ব করতেই পারেন বাংলার আপামর ক্রীড়াপ্রেমী। শাহরুখ খানের নাইট রাইডার্স আইপিএল জেতার সাত মাসের মধ্যে সৌরভের আটলেটিকো জিতল আইএসএল। কোনও দিন আইপিএল জিততে না পারার যদি কোনও দুঃখ বা হতাশা সৌরভের থাকে তো সেটাও ২০ ডিসেম্বর, ২০১৪-র পর বোরহা-অর্ণব-বেটে-রফিকদের সৌজন্যে তিনি ভুললেন দেশের সেরা ফুটবল-মঞ্চে।
দেশের অন্যতম নামী শিল্পপতিরা বসে। মুকেশ অম্বানি থেকে বিজয় মাল্য। কিন্তু ভিভিআইপি এনক্লোজারে সবার চোখ ছিল বিশেষ দু’টো চেয়ারে। কিছুটা দূরত্ব রেখে সেখানে বসেছিলেন ফাইনালিস্ট দু’দলের দুই অন্যতম মালিকসচিন তেন্ডুলকর আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
আইপিএলের জন্য বিখ্যাত ডি ওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে সচিন বহু ম্যাচ জিতিয়েছেন মুম্বইকে ইন্ডিয়ান্সকে। ফুটবলেও যে হারতে চান না সেটা বোঝা গিয়েছিল ফাইনাল শুরুর আগেই। তাঁর সেই অন্ধ ভক্ত সুধীর কুমার গৌতম ফুটবল মাঠেও জাতীয় পতাকা নিয়ে এসেছিলেন। গোটা বিশ্বের ক্রিকেট মাঠে সচিনকে যে ভাবে সমর্থন জানাতেন, সেই ভঙ্গিতে গর্জন করছিলেন মাঝেমাঝেই। সচিনের ডান দিকের গ্যালারি থেকে। ভিভিআইপি বক্সে সৌরভও বসেছিলেন পরিবার নিয়ে। সচিনের মতোই। কিন্তু সেখানেও সচিনের পাশেই বেশি ভিড় হরভজন সিংহ, অভিষেক বচ্চন, জন আব্রাহামদের। সৌরভের পাশে সেখানে লিয়েন্ডার, আটলেটিকো মাদ্রিদের মালিক মিগুয়েল আর সেই টিমের তারকা ফুটবলার কোকে। দাঁড়িপাল্লার বিচারে সচিনের ‘দল’কেই ভারি মনে হচ্ছিল।
সৌরভ-সচিনকে নিয়ে নীতা অম্বানি যখন মাঠ প্রদক্ষিণ করছেন তখনও গ্যালারি যেন সর্ষেক্ষেত। শুধুই কেরল ব্লাস্টার্সের হলুদ জার্সিতে ভরা। তাঁরা নাগাড়ে তুলছেন মেক্সিকান ওয়েভ। ‘কেরল-কেরল...স্যাচিন-স্যাচিন’ শব্দব্রহ্ম। কোনও কোনও কোণে কিছু আটলেটিকোর লাল-সাদা উঁকি দিচ্ছে। সৌরভ হয়তো যেটা বুঝতে পারেননি তা হল, তাঁর ঠিক নিচের গ্যালারিতে যে অজুর্ন, দ্রোণাচার্যরা বসেছিলেন তাঁদের বেশির ভাগই কলকাতার সমর্থক। সংগঠকদের আমন্ত্রণে চুনী-পিকেরা না এলেও কলকাতা থেকে আসা নইমুদ্দিন, হাবিব, সাব্বির আলি, ভাইচুং ভুটিয়া, শান্তি মল্লিকসবাই গলা ফাটাচ্ছিলেন কলকাতার জন্য। আর্নালের সহজ সুযোগ নষ্টের সময় এঁরা সৌরভের মতোই মাথা চাপড়েছেন। আবার কেরলের মাইকেল চোপড়ার একের পর এক নিশ্চিত গোল আটলেটিকো কিপার বেটে রুখে দেওয়ার পর চিত্কার করেছেন।
ট্রফিটা নেওয়ার সময় সৌরভ ডেকে নিলেন দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সচিনকে। যা ক্যামেরাবন্দি করতে ফটোগ্রাফারদের প্রবল হুড়োহুড়ি। আফসোসের মুখ নিয়ে ‘মাস্টার’ এসে দাঁড়ালেন ‘দাদা’-র পাশে। যেমন আফসোস ঝরে পড়ছিল তাঁর টিমের ম্যানেজার-কাম-গোলকিপার ডেভিড জেমসের মুখে। “লোকে স্কোরারকে নিয়ে নাচানাচি করে। কিন্তু কলকাতা কিপার বেটে যে ভাবে আমাদের থামিয়ে দিল, মুখের সামনে থেকে জয় ছিনিয়ে নিয়ে গেল তা অবিশ্বাস্য। কেবল আমার কিপার হিসাবে এটুকুই ভাল লাগছে যে, ওকে নিয়ে এর পর আলোচনা হবে ভেবে।”
জেমস যখন এ সব কথা বলছেন তখন বদলে গিয়েছে জনতার আওয়াজ। হাবাস যখন পাশে গার্সিয়া আর রফিককে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে ঢুকছেন তখন অস্থায়ী ব্যারিকেড ভেঙে তাঁর পিছনে সারি-সারি আটলেটিকো সমর্থক। তাঁদের রোখা যাচ্ছিল না। কলকাতায় ডার্বি জেতার পর এ রকম দৃশ্য দেখা চোখও অবাক হচ্ছিল! এটা ভেবে যে, সচিনের পাড়ায় হাবাস যে ভাবে দাদাগিরি করে গেলেন তা মনে থাকবে বহু দিন।
গ্যালারিতে উচ্ছ্বাস অন্যতম টিম মালিকের।
বঙ্গসন্তান রফিক যদি আট কোটির ট্রফি কলকাতাকে এনে দেন, তা হলে কলকাতা কিপার ছিলেন তার হোতা। বেটে আজ গোলের নীচে না থাকলে রফিকের লাখ ওয়াটের আলো হয়তো দেখতে পেত না কলকাতা। আর কোচ হাবাস? ওস্তাদো কা ওস্তাদ!
‘দাদা’-র টিমকে চ্যাম্পিয়ন করার লক্ষ্যে এ রকম জেদি-একরোখা-টার্গেটে স্থির লোকই যে দরকার ছিল! শনিবারের পর সৌরভ আর হাবাস যেন কোথায় একটা মিলে গেলেন! যেখানে হেরে যাওয়ার কোনও গল্পই নেই। আছে শুধুই দা-দা-গি-রি!
আটলেটিকো: বেটে, কিংশুক, অর্ণব, হোসেমি, পদানি, আর্নল, নাতো, বোরহা, সঞ্জু, বলজিত্, রফি (রফিক)।
অনেক দিন পর এ ভাবে সাফল্য সেলিব্রেট করলাম। যখন খেলতাম তখন এ রকম প্রায়ই করতাম। দারুণ জিতল ছেলেরা। ওরা ভাল খেলবে জানতাম, কিন্তু এমন জয়টা বেশ অপ্রত্যাশিত। প্রথম আইএসএলেই আমরা চ্যাম্পিয়ন হলাম, এটা বড় ব্যাপার। ছেলেরা খুব খেটেছে। তারই ফল পেল ওরা। আজ মাঠে এত লোক আমাদের জন্য গলা ফাটাতে আসবে ভাবিনি। এ ভাবে যে প্রথম আইএসএল সফল হবে প্রত্যাশা করিনি। ফুটবলের শহরে বড় হয়েছি বলে এটা দেখে ভাল লাগছে। সচিন আর আমি প্রায় একসঙ্গে ক্রিকেট জীবন শুরু করেছি, বড় হয়েছি। এ বার আমরা দু’জনেই ফুটবলের জন্য কিছু করতে চাই। কলকাতায় ফিরে কী হবে জানি না। কাল সকালে বিশেষ বিমানে শহরে ফিরছি আমরা। নিশ্চয়ই প্রচুর লোক আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে আসবেন এয়ারপোর্টে।
—সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়
ছবি: উত্পল সরকার ও পিটিআই।