গ্লেন ম্যাক্সওয়েল— এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ওভার বাউন্ডারির মালিক।
ডেভিড মিলার— আইপিএলের ইতিহাসে তৃতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরিকারী।
মিচেল জনসন— ২০০৯-এর আইসিসি-র বর্ষসেরা ক্রকেটার।
আপাদমস্তক লালে মোড়া বরাবাটি স্টেডিয়ামের চতুর্দিকে হালফিলে এমনই রেকর্ডের সিংহগর্জন যে, চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। মাঠে ঢুকতে না ঢুকতে ভেসে উঠবে বিশাল বিশাল সব কাটআউট। কোনওটায় ম্যাড ম্যাক্সের আইপিএল-কীর্তির বিবরণী সযত্নে লেখা। কোনওটায় ডেভিড মিলারের ‘কিলার ইন্সটিঙ্কট’-এর পরিচয়। কোনওটায় আবার উদীয়মান সন্দীপ শর্মা। আইপিএল সেভেনে বোলারদের পৃথিবীতে নতুন ‘আবিষ্কার’ হিসেবে যাঁকে ধরা হচ্ছে।
দেখে কে বলবে, সমুদ্র-নিকটবর্তী এই শহর পঞ্জাবের সত্যিকারের ‘ঘর’ নয়!
দেখে কে বলবে, সমুদ্র-নিকটবর্তী এই শহর গত বছর পর্যন্ত কিং খানের টিমের সেকেন্ড হোম ছিল?
কপাল বটে কেকেআরের! আইপিএল সেভেন দেশে ফিরেছে প্রায় দু’সপ্তাহ হতে চলল, কিন্তু নাইট শিবির এখনও ‘উদ্বাস্তু’! কোটলায় পরপর ম্যাচ পেয়েছে দিল্লি, মুম্বইয়ের দুর্গ ওয়াংখেড়েতে এ বারও প্রায় অটুট (১১ ম্যাচের পর ওয়াংখেড়েতে তারা সিএসকের কাছে ওয়াংখেড়েতে হারল), চেন্নাই সুপার কিংস পর্যন্ত তাদের অধিনায়কের শহরে হোম টিমের মর্যাদা পাচ্ছে। সেখানে কেকেআর? ইডেনে ছিল চারটে ম্যাচ, নির্বাচনী ঝঞ্ঝাটে পড়ে কমে দাঁড়াল তিনটেয়। তার উপর আসন্ন প্রতিপক্ষ-সমষ্টির উপাখ্যান যা, তাতে ইডেনে পা দেওয়ার আগেই গৌতম গম্ভীরদের আইপিএল অভিযান কটকের আকাশের মতোই মেঘলা দেখাচ্ছে। কোথাও প্রতিবন্ধকতার নাম মারণ-মালিঙ্গা, কোথাও দাঁড়িয়ে স্টেইন-গান, সবার আগে অবশ্যই ম্যাড ম্যাক্স। আরসিবি-র বিরুদ্ধে ‘হাতের সুখ’ মনমতো হয়নি। মাত্র পঁচিশেই আটকে যেতে হয়েছে। আর কটকের পাটা পিচে তিনি কী বস্তু, সবচেয়ে ভাল বোধহয় জানেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। চার দিন আগে ৩৮ বলে ৯০ তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছে!
শনিবার প্রায় গোটা দিন ঝিরঝিরে বৃষ্টি চলল কটকে। নাইটরা প্রবল তোড়জোর করে প্র্যাকটিসে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ চালানো সম্ভব হল না। রবিবার ম্যাক্সওয়েলের ব্যাট ক্রুদ্ধ হুঙ্কার ছাড়লে যেমন বিপদ, তেমনই বিপদ আবার ম্যাচটা বৃষ্টিতে ভেস্তে গেলে। কটক-আকাশের পূর্বাভাস কিন্তু বলছে, সম্ভাবনা আছে। আর লিগ টেবলের যা অবস্থা, তাতে ম্যাচটা জিততে হবে কেকেআরকে। প্রয়োজন দু’পয়েন্টের। বৃষ্টির পাল্লায় পড়ে পয়েন্ট ভাগাভাগি মানে কপালে এক পয়েন্ট। যেটা হলে চরম সর্বনাশ। কারণ ইতিমধ্যে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে শিখর ধবনের হায়দরাবাদ। তাদের তাড়া করতে হলে পঞ্জাব ম্যাচ জিতে তাড়া করতে হবে।
বৃষ্টি আটকানোর উপায় নেই। তবে শোনা গেল, ম্যাক্সওয়েলের ‘রাহুগ্রাস’ কাটিয়ে উঠতে বিবিধ স্ট্র্যাটেজি তৈরি হচ্ছে সোনালি-বেগুনি শিবিরে। কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে বিপ্লবকারী ম্যাড ম্যাক্সকে থামাতে গম্ভীররা দ্বারস্থ টেস্ট ক্রিকেটের ‘সেশন থিওরির’! কী রকম? কেকেআর ম্যানেজমেন্টের এক জনের কথায়, টেস্টে যেমন সেশন জয়ের উপর নির্ভর করে যুদ্ধের ভবিতব্য, ঠিক একই স্ট্র্যাটেজি গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টিতে প্রযোজ্য। এখানে একটা সেশন, দু-আড়াই ঘণ্টার টাইম পিরিয়ড নয়। দু’টো থেকে তিনটে ওভার। ম্যাক্সওয়েল ক্রিজে নামার সঙ্গে সঙ্গেই যে বল-নিধন যজ্ঞ শুরু করে দিচ্ছেন, তার পাল্টা হিসেবে এটা ব্যবহার করতে চায় কেকেআর। মনে করা হচ্ছে, দু’তিনটে ওভার যদি ম্যাক্সওয়েল-ঝড় আটকে রাখা যায়, তা হলে তিনি সুযোগ দিতে বাধ্য। নাইটদের আগাম সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে, ম্যাক্সওয়েল শো শুরু হয়ে গেলে তোমরা আতঙ্কে পড়ে যেও না। মনে রেখো, প্রতিটা বল মারতে যাওয়া মানে বোলারদের প্রচুর সুযোগও তৈরি করে দেওয়া। আরও মনে রেখো, ম্যাক্সওয়েল যে এত বড় বড় রান করছে, তার পিছনে কিন্তু ভাগ্যও আছে। প্রচুর ক্যাচ দিচ্ছে, কিন্তু সেগুলো ফেলে দিচ্ছে ফিল্ডাররা। রবিবার সে সব চলবে না।
আইপিএল সাতে ম্যাক্সওয়েল
ম্যাচ ৮, রান ৪৬০, সর্বোচ্চ ৯৫, গড় ৫৭.৫০, স্ট্রাইক রেট ২০৪.৪৪, হাফ সেঞ্চুরি ৪, বাউন্ডারি ৪৩, ছক্কা ২৯
নাইট কোচ ট্রেভর বেলিস যেমন বিকেলে বলে গেলেন, “ম্যাক্সওয়েল যে ফর্মে রয়েছে, তাতে ওকে থামানো প্রচণ্ড কঠিন। ও যদি অর্ধেক সুযোগও দেয়, আমাদের সেটা কাজে লাগাতেই হবে। ও যে জায়গাগুলোয় স্বচ্ছন্দ নয়, সে সব জায়গায় বল করতে হবে। সহজ বাউন্ডারি দিলে চলবে না একদম।” নাইট শিবিরের অভিমত, ম্যাক্সওয়েলের ব্যাটিংয়ে টেকনিক কম, আত্মবিশ্বাস বেশি। যে আত্মবিশ্বাস স্পিনারদের বিরুদ্ধে যত প্রকট, সুপারফাস্ট পেসারদের সামনে ততটাও নয়। যে ভাবনার ফল হিসেবে রবিবার প্রথম এগারোয় দেখা যেতে পারে মর্নি মর্কেলকে। দীর্ঘাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকান পেসার আমিরশাহি-পর্বে ম্যাক্সওয়েলের স্টাম্প ছিটকে দিয়েছিলেন। অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানের স্কোর তখন ১৫। ম্যাক্সওয়েল প্রসঙ্গ উঠতেই তড়িঘড়ি যেটা মনেও করিয়ে দিলেন বেলিস।
মজার হচ্ছে, বিপক্ষ শিবিরে এমন আতঙ্ক সৃষ্টি করছেন যিনি, বাইশ গজের বাইরে তিনি কিন্তু মোটেই আতঙ্ক-উৎপাদক নন। বরং কিংস ইলেভেনের অন্দরমহলে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মাঠের বাইরের ম্যাক্সওয়েল একেবারে মাটির মানুষ, ডাউন টু আর্থ। ‘আমি গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, অতএব সমঝে চলো’ জাতীয় দেখনদারির ছিটেফোঁটা নাকি নেই। ক্রিজের উল্টো দিকে তাঁর সঙ্গে যে-ই থাকুক না কেন, তাকে নাকি ম্যাক্সওয়েল নির্দ্বিধায় বলে দেন আমি চালিয়ে খেলছি, তুমিও খেলো। অফ-টাইমে সতীর্থদের সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ার্কি তাঁর বিশেষ পছন্দ। যার বেশির ভাগটাই নাকি বাঁচিয়ে রাখেন পুল সেশনের জন্য। কোনও প্লেয়ার জলে নামতে দোনামনা করলেই তাঁকে এক ধাক্কায় পুলে ফেলে দিতে দু’মিনিট ভাবেন না। সতীর্থদের মাথা থেকে টুপি তুলে দৌড় দিতেও ওস্তাদ! ক্রিকেটটা ম্যাক্সওয়েলের ক্রিকেট-মাঠেই থাকে। বাইরে আসে না। কেউ কোনও দিন নাকি তাঁর হাতে ক্রিকেটের বই দেখেনি। কিন্তু ক্রিজে মাঝে মাঝেই সতীর্থকে চোখ মারতে দেখেছে। এমন সিআর সেভেন-সদৃশ চরিত্রকে ঘিরে পঞ্জাবের টিম আবর্তিত হবে, খুব স্বাভাবিক। শোনা গেল, কেকেআরের বিরুদ্ধে নামার চব্বিশ ঘণ্টা আগে কোনও টিম মিটিং হয়নি। পুল সেশন হয়েছে। কিন্তু ম্যাচ নিয়ে আলোচনা নয়, ও সব রবিবার সকালে!
সত্যি, যেমন বর্ণময় মহানায়ক তেমন বর্ণময় তাঁর টিম। এক বনাম পাঁচে সত্যিই অনেক তফাত। আর কেকেআর নিয়ে ঢিলেঢালা মনোভাবে কিংসের বার্তাটাও খুব পরিষ্কার নয় কি?
মাঠ থেকে বাইশ গজ সর্বত্র লাল জার্সির গালিচা পাতা শেষ। এখন শুধুই সেখানে ম্যাক্সওয়েল নামক মৃত্যু-পরোয়ানা হাতে নিয়ে নাইট-নিধনের প্রতীক্ষা!