রেকর্ড নয়, হিমালয়ের চ্যালেঞ্জটাই আসল, বললেন মার্ক

সাদা শার্ট-নীল জিন্স, মাঝারি উচ্চতা। বছর তেষট্টির রোগাসোগা-হাসিমুখ চেহারাটা দেখলেও কথাগুলো বিশ্বাস না করে পারা যায় না। বিশেষ করে মৃদুভাষী এই ফরাসি মানুষটির গোটা জীবনটাই যখন হাসতে হাসতে বলে যাওয়া একটা রূপকথা! আর সেই সত্যি-রূপকথায় রয়েছে ১৮ ঘণ্টায় প্রায় ৮৪৮১ মিটার উচ্চতার মাকালু, প্রায় ৮২০০ মিটার উচ্চতার চো ইউ এবং মাত্র ২২ ঘণ্টায় ৮৮৪৮ মিটারের এভারেস্ট জয় এবং যথারীতি অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া! এবং সব ক’টাই ১৯৮৮ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে!

Advertisement

সোমঋতা ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৪ ০৪:০০
Share:

কলকাতায় মার্ক বাতার্দ। সুদীপ আচার্যের ছবি।

সব মিলিয়ে কতগুলো শৃঙ্গ জয় করেছেন, মার্ক?

Advertisement

তা প্রায় হাজার আটেক হবে।

সবগুলোই অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ছাড়া?

Advertisement

সব...সব। কখনও দরকার হয়নি...

অন্য কেউ কথাগুলো বললে হয়তো মনে হত বাড়াবাড়ি! কিন্তু মিনিট কয়েক আগেই স্বচক্ষে দেখেছি আল্পসের এক শৃঙ্গ জয়ের ভিডিও। প্রায় ৭০ কিলো ওজন কাঁধে খাড়া পর্বতের গা বেয়ে উঠে যাচ্ছেন মার্ক। সেখানেও সঙ্গে নেই অক্সিজেন ট্যাঙ্ক বা মাস্ক।

সাদা শার্ট-নীল জিন্স, মাঝারি উচ্চতা। বছর তেষট্টির রোগাসোগা-হাসিমুখ চেহারাটা দেখলেও কথাগুলো বিশ্বাস না করে পারা যায় না। বিশেষ করে মৃদুভাষী এই ফরাসি মানুষটির গোটা জীবনটাই যখন হাসতে হাসতে বলে যাওয়া একটা রূপকথা! আর সেই সত্যি-রূপকথায় রয়েছে ১৮ ঘণ্টায় প্রায় ৮৪৮১ মিটার উচ্চতার মাকালু, প্রায় ৮২০০ মিটার উচ্চতার চো ইউ এবং মাত্র ২২ ঘণ্টায় ৮৮৪৮ মিটারের এভারেস্ট জয় এবং যথারীতি অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া! এবং সব ক’টাই ১৯৮৮ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে!

অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া এত কম সময়ে এভারেস্ট জয়ের রেকর্ড তাঁরই। তবে নিজের ‘দ্য স্প্রিন্টার অব এভারেস্ট’ খেতাব নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট নন। কথায় কথায় বললেন, “এভারেস্ট জয় যেন একটা ট্রেন্ড হয়ে গিয়েছে এখন। যেন একটা ট্যুরিস্ট স্পট। কিন্তু কত নাম-না-জানা শৃঙ্গ রয়েছে, তার খবর ক’জন রাখে?”

গল্প হচ্ছিল মার্ক বাতার্দ-এর সঙ্গে। মাসখানেক হল ফ্রান্স থেকে এ দেশে এসেছেন তিনি। উদ্দেশ্য আলিয়ঁস ফ্রাঁসেজ দ্যু বেঙ্গল-এর সহযোগিতায় আত্মজীবনী ‘লা সখ্তি দে সিম’ বা ‘আউট বিয়ন্ড দ্য সামিট্স’কে বাঙালি তথা ভারতীয় পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। ভারতীয় সহচর গণেশের সঙ্গে ইতিমধ্যেই ঘোরা হয়ে গিয়েছে উত্তর ভারতের নানা জায়গা। এ বার কলকাতায়। এখান থেকে দিল্লি-মুম্বই হয়ে ফিরে যাবেন স্বদেশে। এই ‘আউট বিয়ন্ড দ্য সামিট্স’ পর্বতারোহণ নিয়ে মার্কের তৃতীয় বই।

মাউন্টেনিয়ারিং-এই কি গল্পের শেষ? না, ততটা সরলরৈখিক নয় মার্কের জীবন। পেন্টিং, মাউন্টেনিয়ারিং ও সমকামিতা আপাত ভাবে কোনও যোগ নেই তিনটে বিষয়ের মধ্যে। প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ফিভার অব দ্য সামিট্স’ও প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। মার্ক বাতার্দ-এর ষাটটা বসন্ত পেরিয়ে যাওয়া পথটা তো উপপাদ্য মেনে চলা অঙ্ক নয়!

বছর চোদ্দোর মার্ক ভাল ছবি আঁকত। কিন্তু আঁকার মাস্টারমশাই খুব সমালোচনা করতেন সে সব ছবির। কাজেই তখনকার মতো সে কাজে ইতি। স্বাস্থ্য ছিল বেশ শক্তপোক্ত। বাড়ির লোক বলল, ‘খেলাধুলোয় মন দাও’। কিন্তু খেলার প্রতিযোগিতাগুলো ঘোরতর নাপসন্দ! তাই তখন থেকেই শুরু পাহাড় চড়া। এবং তার পরের তিরিশটা বছর তুলি-ক্যানভাস নয়, সঙ্গী শুধু রুকস্যাক আর ক্লাইম্বিং রোপ। সে জন্য অবশ্য আঁকার মাস্টারমশাইয়ের কাছে চিরকৃতজ্ঞ মার্ক।

শৃঙ্গের পর শৃঙ্গ জয় করতে করতে বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। বিবাহিত জীবনের অনেকটা পেরিয়ে এসে এবং পিতৃত্বের স্বাদ পেয়ে যাওয়ার পরেও মার্ক আবিষ্কার করেছেন নিজের সমকামী সত্তাকে। আত্মজীবনীতে সপাটে বলে দিয়েছেন সব কিছুই, কিন্তু খুব সহজ ভাবে। আসলে উত্তর প্রজন্মের কাছে বহু অভিজ্ঞতা পৌঁছে দেওয়ার এবং অনেক ভুল পথকে চোখে আঙুল দিয়ে চিনিয়ে দেওয়ার একটা দায় থেকে যায় পূর্বসূরিদের, এমনটাই বিশ্বাস করেন মার্ক।

তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে জেগে থাকে দূরের হাতছানি। ফরাসিতে মাউন্টেনিয়ারিং-কে বলে ‘আলপিনিজ্ম’ আল্পস্ থেকে এসেছে কথাটা। তবে ‘হিমালয়িজ্ম’-এর চ্যালেঞ্জটাই আলাদা, জানালেন ফরাসি ‘আলপিনিস্ত’। তবে চুড়োর পর চুড়ো জয় করে বেড়ানোর পরেও তো পড়ে থাকে আর একটা জীবন। তখন ফিরতে ইচ্ছে করে শিকড়ে। তাই বছর বারো আগে হঠাৎই ফের হাতে তুলি।

“তা বলে ভেবো না, আমি বুড়ো হয়ে গিয়েছি! এক্সপিডিশন চলছেই টুকটাক”, শুধরে দেন ষাটোর্ধ্ব তরুণ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement