বর্ডার-গাওস্কর ট্রফি ফিরিয়ে এনে স্মিথ। সিডনিতে। ছবি: গেটি ইমেজেস
সিডনি টেস্ট কোনও রকমে ড্র করে সিরিজ শেষ করল ভারত। শেষ দিনে বেশ চাপের মধ্যেই ম্যাচটা বের করতে হল ভারতীয় দলকে। বিশেষ করে চা-বিরতির পরের ওভারগুলোয়। তবে অজিঙ্ক রাহানে একদম ঠিক সময়ে দায়িত্বের সঙ্গে হাল ধরে আরও একটা হার বাঁচিয়ে দেশের মুখরক্ষা করল।
ধসটা শুরু হয়েছিল বিরাট কোহলি আউট হয়ে যাওয়ার পরেই। দ্বিতীয় ইনিংসে বিরাটের ছেচল্লিশ রানে ফেরা প্রকৃতির নিয়মেই হয়েছে। প্রথম ইনিংসে ওই ম্যারাথন ব্যাটিংয়ের পর দ্বিতীয় ইনিংসে আবার বিস্ময়কর কিছু করে দেখাতে হলে অতিমানবিক ক্ষমতা লাগত, যা বিরাটের পক্ষেও অসম্ভব ছিল। প্রতিটা টেস্ট সেঞ্চুরির জন্য শুধু শারীরিক শক্তি ক্ষয় হয় না, প্রচণ্ড মানসিক শক্তি লাগে। বিশেষ করে এই সিরিজে সব মিলিয়ে উইকেটে বিরাট যত সময় কাটিয়েছে, সেটা হিসাব করলে বোঝা যাবে, ক্লান্তি আসাটাই স্বাভাবিক।
সিরিজে বিরাটের ব্যাটিং বহু দিন ক্রিকেটপ্রেমীর চোখে লেগে থাকবে। অসাধারণ বললেও খুব কম বলা হয়। ওর আগ্রাসন, আবেগ, একাগ্রতার তারিফ করতেই হবে। তার সঙ্গে জেতার খিদেটা ওকে বাকি সবার থেকে আলাদা করে দেয়। যে জন্য আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হিসাবে বিরাটকেই বেছে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া ওকে নানা ভাবে উত্ত্যক্ত করেছে। অবিরাম স্লেজিং করেছে। কিন্তু বিরাটকে টলাতে পারেনি। উল্টে ও পাল্টা জবাব মুখে তো দিয়েইছে। তবে তার চেয়ে ঢের বেশি দাপটে কথা বলেছে ওর ব্যাট! বিরাটের ব্যাটের ঠিক মাঝখানে বল লেগে ‘ঠকাস’ শব্দটার প্রতিধ্বনি আগামী ক’বছর গোটা তাসমানিয়া জুড়ে শোনা যাবে।
বিরাট তরুণ নেতা। ক্রিকেট নিয়ে যার উত্সাহ আর মানসিকতা সংক্রামক। খুব দ্রুত ওর টিমমেটদের মধ্যে সেটা ছড়িয়ে যেতে বাধ্য। বলেই দিচ্ছি, ভবিষ্যতে বিরাট কোহলির কাছে আমার প্রত্যাশাও কিন্তু বিরাট!
ভারতের গোটা বছরটাই প্রায় বিদেশ সফরের বছর ছিল। শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকা সফর দিয়ে। শেষ হল অস্ট্রেলিয়ায়। আগেই বলেছিলাম, পর পর বিদেশ সফরের এই রগড়ানি সেই ক্রিকেটারদের তুলে আনবে যারা টিকে থাকার জন্য এসেছে। নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেটে। আমার মনে হচ্ছে, বিদেশ সফরের বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা দরকারি প্রশ্নের জবাব আমরা পেয়ে গিয়েছি।
ব্যাটিংয়ে মুরলী বিজয় এবং কে এল রাহুলের মধ্যে দারুণ ওপেনিং জুটি পেয়েছি। এই জুটি কিন্তু আগামী বেশ কয়েক বছর টেস্টে ওপেনিংটা দায়িত্বের সঙ্গে করে দেখাবে। মিডল অর্ডারে বিরাট আর রাহানে স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। রোহিত শর্মাকে টেস্টে কয়েকটা সুযোগ দেওয়া হলে কিন্তু মিডল অর্ডারে নির্ভরযোগ্য আরও এক জনকে পাওয়া যাবে। তবে হতাশ করেছে চেতেশ্বর পূজারা। টেস্টে ও শুরুটা বিস্ফোরক করেছিল। কিন্তু ইদানীং ব্যাট হাতে একেবারেই দাগ কাটতে পারছে না। তবু বলব, চেতেশ্বরকে আরও সুযোগ দেওয়া উচিত। যথেষ্ট ভাল ব্যাটসম্যান। তবে ওর মতো প্লেয়ারের পিঠে মাঝে মাঝে হাত রেখে বলতে হয়, পাশে আছি।
ব্যাটিংয়ে আশার আলো থাকলেও ভারতের বোলিং পারফরম্যান্সকে অবশ্য একেবারেই ইতিবাচক বলা যাচ্ছে না। এখনও বলছি, আমাদের বোলারদের প্রতিভার অভাব নেই। কিন্তু টেস্ট পর্যায়ে কী করে বল করতে হয়, সেই জ্ঞানের প্রচণ্ড অভাব। ওদের বলব, জশ হ্যাজলউডকে দেখে শিখতে। সিডনিতে মাত্র নিজের তৃতীয় টেস্ট খেলল। কিন্তু কী নিখুঁত! ক্রেগ ম্যাকডারমটের পরামর্শে টেস্ট পর্যায়ে সফল হওয়াটাও শিখে যাবে।
ভারতীয় পেসাররা বরং হ্যাজলউডের বোলিংয়ের একটা সিডি যোগাড় করুক। দেখে শিখুক, বোলিংয়ের প্রাথমিক ব্যাপারগুলো কী রকম সহজ-সরল রাখে ছেলেটা। উমেশ বা শামির গতি ওর নেই। কিন্তু বলটা দারুণ জায়গায় রেখে যায়। বোলিং সমস্যা সমাধানে কিন্তু বিরাট কোহলিকে নেতা হিসাবে এগিয়ে আসতে হবে। টিমের সঙ্গে এমন কয়েকজনকে রাখতে হবে যারা টেস্ট বোলিংয়ের কাজটা সফল ভাবে দিনের পর দিন করেছে এবং উমেশদের প্রাথমিক ব্যাপারগুলো ঠিকঠাক শিখিয়ে দিতে পারবে।
স্পিনারদেরও আত্মসমীক্ষা দরকার। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের এটা সম্ভবত ছয় বা সাত নম্বর বিদেশ সফর। কিন্তু এখনও বল করতে গিয়ে লাইন ঠিক রাখতে পারছে না। বোলিং বিভাগের এক জন সিনিয়র হিসাবে ওর আরও অনেক বেশি আক্রমণাত্মক হওয়া উচিত ছিল। ক্রিকেট বিশ্বের সমীহ আদায় করতে চাইলে বিদেশের মাঠে বোলিংয়ের নেতৃত্ব দেওয়াটা ওকে শিখতে হবে। আমার মতে ওর অনিল কুম্বলের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো দরকার। যাতে সব ধরনের কন্ডিশনে আক্রমণাত্মক স্পিন বোলিংয়ের শিল্পটা শিখতে পারে।
অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংস: ৫৭২-৭ ডিঃ।
ভারত প্রথম ইনিংস: ৪৭৫।
অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংস: ২৫১-৬ ডিঃ।
ভারত দ্বিতীয় ইনিংস
বিজয় ক হাডিন বো হ্যাজলউড ৮০
রাহুল ক ওয়ার্নার বো লিয়ঁ ১৬
রোহিত ক স্মিথ বো ওয়াটসন ৩৯
বিরাট ক ওয়াটসন বো স্টার্ক ৪৬
রাহানে নঃআঃ ৩৮
রায়না এলবিডব্লিউ স্টার্ক ০
ঋদ্ধিমান এলবিডব্লিউ লিয়ঁ ০
অশ্বিন এলবিডব্লিউ হ্যাজলউড ১
ভুবনেশ্বর নঃআঃ ২০
অতিরিক্ত ১২
মোট ২৫২-৭
পতন: ৪৮, ১০৪, ১৭৮, ২০১, ২০৩, ২০৮, ২১৭।
বোলিং: স্টার্ক ১৯-৭-৩৬-২, হ্যারিস ১৩-৩-৩৪-০, লিয়ঁ ৩০.৫-৫-১১০-২, হ্যাজলউড ১৭-৭-৩১-২, স্মিথ ২-০-৭-০, ওয়াটসন ৮-২-২২-১।