শনিবারের জিপিও কেন সংগ্রাহকদের কাছে সোনার খনি?

সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে গোধূলি অবধি কলকাতা জিপিও-র অফিসপাড়া জেগে থাকে। তারপর রোদের তেজ একটু ঝিমোতেই এখানে ধীরে ধীরে আসতে শুরু করেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।

Advertisement

সৃজন দে সরকার

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৮ ১৫:৩৪
Share:

কলকাতা জিপিও অফিস।

আক্ষরিক অর্থেই যেন ‘শখের বাজার’। সংগ্রাহকদের কাছে ‘বারের পুজো’ বললেও বুঝি বা কম বলা হয়! কারণ, ফি শনিবার দুপুরের রোদ একটু পড়লেই বসে যায় এই অভিনব বাজার, কলকাতা জিপিও-র সিঁড়িতে-চাতালে। কলকাতা ছাড়াও বহু প্রত্যন্ত এলাকা থেকে মানুষ এখানে ছুটে আসেন কিসের নেশায়!

Advertisement

সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে গোধূলি অবধি কলকাতা জিপিও-র অফিসপাড়া জেগে থাকে। তারপর রোদের তেজ একটু ঝিমোতেই এখানে ধীরে ধীরে আসতে শুরু করেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। বলে রাখা ভাল, এই জিপিও-র ভেতরেই রয়েছে একটি অনবদ্য ডাক জাদুঘর। সে কথা অন্য দিন বলা যাবে। এখানে লুকিয়ে রয়েছে আরও অনেক গল্প। তবে এই বড় পোস্ট অফিস এবং তার সামনের সিঁড়ি, পেভার ফুটপাথ জুড়ে জেগে ওঠা এই সংগ্রহ সামগ্রীর বাজারটি কিন্তু চমৎকার। সারা দেশে এমনটি বিরল। কলকাতার এই অনবদ্য বাজারটির কথা কিন্তু এখনও অনেক কলকাতাপ্রেমীর কাছেই অজানা!

ঠিক কবে থেকে এটি শুরু হয় সে নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে অনেকেই মনে করেন, ৮০-র দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে জমে ওঠে এই বাজার। জিপিও-র ব্যস্ততা চিরদিনই। কত না পার্সেল, চিঠি, ইনল্যান্ড লেটার, পোস্টকার্ড, মানি অর্ডার আরও কত কি! বহু মানুষের আনাগোনা। কিছু মানুষ আসতেন নতুন ডাক টিকিট সংগ্রহের জন্য। কোনও বিশেষ দিবস উপলক্ষে ডাক বিভাগ থেকে প্রকাশ পায় বিশেষ দিবস কভার বা ‘ফার্স্ট ডে কভার’, যেমন প্রকাশ পায় বিশেষ ডাকটিকিট। ফার্স্ট ডে কভার যে দিন প্রকাশ পাচ্ছে, শুধুমাত্র সেই দিনের জন্যই ব্যবহৃত হয় একটি বিশেষ প্রথম দিবস ছাপ বা ক্যানসেলেশন। এগুলি সংগ্রাহকদের কাছে ভীষণ মূল্যবান।

Advertisement

আরও পড়ুন:

গরাণহাটা ও জোড়াসাঁকোর ঐতিহ্য পুরোপুরি লুপ্ত হয়নি

সাবেক চিৎপুর রোড, অধুনা রবীন্দ্র সরণি যেন স্মৃতির সরণি

বেলা বাড়লেই আসতে শুরু করেন ক্রেতা-বিক্রেতারা

এই জিনিসগুলি সংগ্রহের জন্যই সংগ্রাহকেরা আসতেন এখানে। তাঁদের জন্যই এখানে তৈরি হয় ফিলাটেলিক ব্যুরো। এই সংগ্রাহকদের উৎসাহ থেকেই ক্রমে ব্যুরো-র বাইরে আসতে শুরু করে নানাবিধ মুদ্রা। ডাকবিভাগের উপাদানের মতো মুদ্রাও স্মরণীয় হয়। একটি সাধারণ মুদ্রা বা ডেফিনিটিভ কয়েন আর একটি কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা ঘটনা উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক মুদ্রা বা ‘কমেমোরেটিভ কয়েন’। এই দু’য়েরই চাহিদা রয়েছে সংগ্রাহকদের কাছে। এখানে অতএব জমায়েত হ’তে থাকল ক্রেতা এবং বিক্রেতাদের। কিন্তু ডাকবিভাগের সঙ্গে তো এর কোন সম্পর্ক নেই, অতএব তাঁরা জায়গা করে নিলেন সিঁড়িতে-রাস্তায়-রেলিংয়ে। তারপর চাহিদা বাড়তে থাকায় ক্রমে এই তালিকায় যুক্ত হতে থাকে নানবিধ জিনিস।

মানুষের চাহিদার কোনও শেষ নেই! যে শখের সূচনা ডাকবিভাগের হাত ধরে, তা অন্যান্য শখের শাখায় ছড়িয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি। ইতিহাস সংগ্রহে অনেকেই উৎসাহী। সেই টানেই উৎসাহী মানুষের ভিড় ক্রমে জমতে থাকল এখানে। নিত্যদিনের অফিসের পর নিজস্ব সংগ্রহের স্বাদ পূরণ। ধীরে ধীরে সেই বেচাকেনা হ’তে থাকল একটা নিয়মিত পর্যায়ে। শুধু পরখ করতে এসে কেউ কেউ হয়ে গিয়েছেন নিয়মিত ক্রেতা। আসলে শখের সীমানা কখনও সীমিত থাকে না! সেই কারণে সাধারণ পোস্ট অফিস কেন্দ্রিক একটা স্থান ক্রমে হয়ে উঠল অন্যান্য শখের সামগ্রীর বাজার। অ্যান্টিক জিনিস সহজলভ্য না হলেও এখানে তথাকথিত ‘ডিলার’দের হাত ধরে আসতে থাকল পুরনো দলিল-দস্তাবেজ, নথি, বই, সংবাদপত্রাদি, চিঠিপত্র, দুষ্প্রাপ্য নানা প্রিন্টের ছবি, পিকচার পোস্টকার্ড, হাতে আঁকা ছোট ছবি, বিখ্যাত ব্যক্তির সই বা সাক্ষরিত নথি-চিঠি, দেশলাই বাক্সের লেবেল, ব্যাজ, স্টিকার, বোতাম, সিনেমার বুকলেট বা লবি কার্ড ইত্যাদি হরেক কিসিমের জিনিসপত্র। অনেকে নিজের বহুকালের জমানো কয়েন এখানে বিক্রি করতেও আসেন। কেউ যদি পুরনো মুদ্রা যাচাই করতে চান, তবেও এখানে নিশ্চিন্তে আসতে পারেন। শনিবারের বিকেলে গেলে দেখা যাবে জহুরির চোখ খুঁজে চলেছে তাঁর অভীষ্ট জিনিসটি, আতস কাচে চোখ রেখে। ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে অমূল্য রতন! সংগ্রাহক মাত্রেই খুঁতখুঁতে হন, তা না হলে আসল জিনিসে হাত লাগে না!

একে বাজার অভিধা দিলে একটু বেশি বলা হয়। বিক্রেতারা এখানে গাছ বা খোলা আকাশের নীচে, লাইটপোস্টের তলায়, জিপিও-র চওড়া সিঁড়িতে বা ফুটপাথ-রেলিং ধরে এলোমেলো বসে যান। তবে অনেক বিক্রেতাই এখানে নিয়মিত বসেন এবং তাঁদের জায়গাও নির্দিষ্ট। অনেকেই আবার অভীষ্ট জিনিসটি হাতে এলে ফোনে জানিয়ে দেন তাঁদের পুরনো খদ্দেরদের। বিক্রেতারা কেউ কাঠের টুলে, অনেকে একটা প্লাস্টিক বিছিয়ে একটা অ্যাটাচি খুলে বসে পড়েন, কেউ সিঁড়ির সাদা পাথরের উপরেই। তবে শুধু সংগ্রহের জিনিসই নয়, এখানে পাওয়া যাবে এই সমস্ত শখের জিনিস সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় উপাদানও। যেমন, ফাইল, কয়েন-ফোল্ডার, অ্যাসিড মুক্ত স্বচ্ছ প্যাকেট বা এই সব জিনিস সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন লেন্স, চিমটে ইত্যাদি।

অতএব, এখানে একবার এসেই দেখুন, হয়তো পেয়ে যেতে পারেন কার্জনের কলম, সই বা সাবেক কলকাতার কবেকার বিবর্ণ ছবি, কে বলতে পারে! এই শখের বাজার থেকেই কলকাতার অনেক সংগ্রাহক খুঁজে পেয়েছেন তাঁদের অমূল্য সংগ্রহের ‘মিসিং লিঙ্ক’। এ ভাবেই সংগ্রহের সঙ্গে ইতিহাস গড়ে তুলছে কলকাতার এই শখের বাজার।

ছবি: লেখক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন