মিরিকের চা বাগান।
মিরিক
উঁচু-নিচু পাহাড়ের ঢাল আর সেই পাহাড়ের ঢালে নামজাদা কোম্পানির চা বাগান। আর শীতের মরসুমে এ দিক ও দিক তাকালেই চোখে পড়বে কমলালেবুর গাছ। গাছগুলো থেকে যেন কমলা আভা ঠিকরে বেরোচ্ছে! ৫,৮০০ ফুট উচ্চতার এই পাহাড়ি শহরের বুক চিতিয়ে শুয়ে আছে সুমেন্দু হ্রদ। সুদীর্ঘ পাইনের বনানী আর তার ছায়া এসে পড়ে লেকের টলটলে জলে। দেখে মনে হবে যেন একটা মায়াঘেরা জায়গায় এসে পড়েছি। আর এই নিয়েই মিরিক মজে থাকে মিরিকে।
মিরিকের আশপাশ ঘুরে দেখে নিতে পারেন— মিরিক গুম্ফা, টিংলিং ভিউপয়েন্ট, টিবেটান গুম্ফা। সুমেন্দু লেক ছাড়িয়ে দূরে পাহাড়ের মাথায় চলে আসুন। এখানেই রামেতি ভিউপয়েন্ট। মেঘ না থাকলে এখান থেকেই দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার। কি অপূর্ব দৃশ্য! না দেখলে বিশ্বাসই করা যাবে না যে প্রকৃতি আপন খেয়ালে নিজের রূপ-রং-গন্ধ কী ভাবে বদলাচ্ছে। বিকেলের সোনারোদ চলকে পড়ে সেই পবিত্র শিখরচুড়োর শরীরে। সূর্যাস্তের অপরূপ শোভা মন ভরিয়ে দেবে। আর পাহাড়ের গায়ে মখমলি সবুজ চা বাগানের ঢেউ এক কথায় অনবদ্য।
আরও পড়ুন, দার্জিলিং-কালিম্পং-লাভা-রিশপ-লোলেগাঁও
শান্ত প্রকৃতির মাঝে এক স্বল্পচেনা নৈস্বর্গিক ঠিকানায় যেতে হলে ঘুরে আসুন লোয়ার মিরিকে। পাহাড়ের ঢালে সবুজে ঘেরা ছোট্ট একটি গ্রাম। গুরুঙ্গ জনজাতিদের বাস। এদের আতিথেয়তা মন ভরিয়ে দেবে আপনার। লোয়ার মিরিকের এই গ্রামের পোশাকি নাম ‘মিরিক বস্তি’ হলেও এই গ্রামের নাম স্কুলদাঁড়া। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে গাছে গাছে হলদে বাহারি কমলালেবু ফুটে আছে। পাহাড়ের মৌনতা ভাঙে পাখির কলবরে। বাহারি ফুলের মেলায় পাখি দেখার আদর্শ ঠিকানা এই স্কুলদাঁড়া। চেনা মিরিকের কাছে অল্পচেনা স্কুলদাঁড়া অজ্ঞাতবাসের এক সেরা ঠিকানা।
মিরিক মনাস্ট্রি।
কী ভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে ট্রেনে/বিমানে এনজেপি। সেখান থেকে গাড়িতে সরাসরি চলে আসা যায় মিরিক। দূরত্ব ৬০ কিমি।
কোথায় থাকবেন: রয়েছে জিটিএ মিরিক ট্যুরিস্ট লজ (০৩৫৪-২২৪৩৩৭১/৭২) ভাড়া ১,৫০০ টাকা।
বেসরকারি হোটেলের মধ্যে রয়েছে হোটেল জগজিৎ (২২৪৩২০৫) ভাড়া ২,২০০-৫,০০০ টাকা। সদ্ভাবনা (২২৪৩৬৫১) ভাড়া ১,৩৫০-১,৫০০ টাকা। দি পার্ক (২২৪৩৩১৯) ভাড়া ১,৩৫০-২,৩৫০ টাকা।
স্কুলদাঁড়ায় থাকার জন্য রয়েছে রাংভাং হোমস্টে ( ০৯৮৩২৯-১৩৬১৭) ভাড়া ১,২৫০ টাকা। খাওয়া জনপ্রতি ৫০০ টাকা। রোধীঘর হোমস্টে (০৯৮৩২৬৩০৩৩০) ভাড়া ১,২৫০ টাকা। খাওয়া জনপ্রতি ৫০০ টাকা।
পালমাজুয়া
এ পাহাড় যেন আরও সুন্দর, আরও সবুজ। কুয়াশা আর মেঘ তো পাহাড়ে দেখাই যায়। তবে এই পাহাড়ে মেঘ আসে, টুক করে ঢুকে পড়ে এর ওর বাড়িতে,বারান্দায়। নির্জন এই পাহাড়িয়া গ্রামে হাঁটলেই কুয়াশার চাদর যেন আষ্টেপৃষ্ঠে গায়ে জড়িয়ে ধরে। রোদ উঠলেই যেন রূপের বদল ঘটে চোখের পলকে। ঘন নীল আকাশের নীচে পাইন, ওক, বারচ, ধুপির ঠাসবুনোটে মোড়া এক ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম পালমাজুয়া। কাছেই রয়েছে সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যান। প্রায় ১৭০ প্রজাতির পাখি দেখা যায় এখানে।
অনবদ্য পালমাজুয়া।
অপরূপ বৃক্ষবৈচিত্রের মাঝে রয়েছে সুন্দর হোমস্টে। মাত্র ১৫ মিনিটের হাঁটাপথে চলে আসুন পালমাজুয়া ভিউপয়েন্টে। চোখের সামনে ধরা দেবে কাঞ্চনজঙ্ঘার অসাধারণ রূপ। শীতে ভোর থেকে প্রায় সারাদিনই হাসিমুখে তার দেখা মেলে। এ ছাড়াও এই ভিউপয়েন্ট থেকে পশ্চিম সিকিমের দারামদিন-কে দেখে নিতে পারেন। এখানকার বন্যপ্রাণের সম্ভার বেশ চমৎকার। সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানের অন্তর্গত হওয়ার ফলে গভীর জঙ্গলে বাঁশবনে রেড পন্ডাদের দেখা মেলে। এ ছাড়া প্যাঙ্গোলিনও দেখতে পাওয়া যায়। মাছ ধরার নেশা যাঁদের আছে, চলে যেতে পারেন কাছেই শিরিখোলায়। মনের সুখে মাছ ধরুন, তার পর ভেজে খান। হোমস্টে-তে রাতে নেপালি ট্র্যাডিশনাল ডান্সের আয়োজন রয়েছে। তবে এর জন্য আলাদা চার্জ লাগে।
আরও পড়ুন: দু’হাত বাড়িয়ে অপেক্ষায় মায়াবী সিকিম
নানা ছোটখাটো ট্রেকরুটও রয়েছে। রোমাঞ্চকর জঙ্গল ট্রেকে পৌঁছে যেতে পারেন ধোতরে, শিরিখোলা, রিম্বিক। এককথায় পালমাজুয়া অনবদ্য।
পালমাজুয়ার পাহাড়ি পতে পড়ুয়ার দল।
কী ভাবে যাবেন: এনজেপি থেকে গাড়িতে চলে আসতে পারেন পালমাজুয়া। দূরত্ব প্রায় ৬৫ কিমি। মানেভঞ্জন থেকে বাতাসি, ধোতরে হয়ে পালমাজুয়া পৌঁছতে হয়।
কোথায় থাকবেন: এখানে থাকার জন্য রয়েছে সুন্দর হোমস্টে। সিঙ্গালিলা জাঙ্গল লজ। ০৯২৩১৫-৮১১৭৭। থাকা-খাওয়া সমেত জনপ্রতি ১৫০০ টাকা। ডান্স, গাইডের জন্য আলাদা চার্জ লাগে।
(লেখক পরিচিতি: ক্লাস নাইনে পড়াকালীন পাড়াতুতো মামার সঙ্গে মাত্র ৭০০ টাকা পকেটে নিয়ে সান্দাকফু ট্রেক। সুযোগ পেলেই প্রিয় পাহাড়ে পালিয়ে যাওয়া। বছরে বার কয়েক উত্তরবঙ্গের অল্পচেনা ডেস্টিনেশনে যাওয়া চাই। কুয়াশামাখা খরস্রোতা নদী কিংবা চলমান জীবনছবিতে ক্লিক, ক্লিক। চলতি পথে মেঠো গানের সুর শুনলেই ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়া। লাদাখে গর্তে সেঁধিয়ে যাওয়া মারমটের ছবি তুলতে ভিজে মাটিতে সটান শুয়ে অপেক্ষায় থাকা— এই নিয়েই ক্যামেরা আর কলম সঙ্গী করে ২২টা বছর। প্রকৃতির টানে ছুটে বেড়ানোটা থামেনি।)
ছবি: শান্তনু চক্রবর্তী ও তীর্থঙ্কর গুরুঙ্গ।