ওসলা গ্রামের কাছে। ছবি: লেখক।
এ পথটি গাড়োয়ালের মাঝে খুবই জনপ্রিয় ট্রেকরুট। সান্দাকফু ও পিন্ডারিজিরো পয়েন্টে যাওয়ার মতো এ পথেও প্রতি বছর বহু পর্বত পদযাত্রীর সমাগম হয়। থাকা-খাওয়ার সামান্য ব্যবস্থা সমেত রয়েছে সুন্দর পথঘাট। গ্রাম, জঙ্গল, বুগিয়াল, হিমবাহ, আবার হিমবাহ ছাড়িয়ে তুষারাবৃত পর্বতচূড়ায় হাতছানি— সবই আছে এই অল্প দিনের সহজ ট্রেকিং প্রোগ্রামে। এ ছাড়াও ওসলা গ্রামে দুর্যোধনের মন্দির দর্শন এক বাড়তি পাওনা হবে।
ট্রেনে দেহরাদূন। দেহরাদূন থেকে বাসে শাঁকরি (দূরত্ব ২১২ কিমি)। শাঁকরি থেকে সে দিনই জিপে তালুকা পৌঁছে যাবেন (দূরত্ব ১১কিমি)। থাকার জন্য ফরেস্ট রেস্ট হাউস ও গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের (জি এম ভি এন) বাংলো আছে।
প্রথম দিন তালুকা (২১০০ মি)-সীমা (২৭০০ মি.)-১১ কিমি
হর-কি-দূন নালাটিকে বাঁ দিকে রেখে অল্প অল্প চড়াইপথ।
তালুকা থেকে ফরেস্ট বাংলোটিকে বাঁ দিকে রেখে পূর্বমুখী পথে নেমে আসতে হবে হর-কি-দূন নালার ধারে। ক্ষণিকের জন্য পুল পেরিয়ে চলে আসতে হবে নদীর ডানতটে। খানিকটা এগিয়ে আবার ফিরে আসবেন বামতটে। হর-কি-দূন নালা আরও নীচে মিলিত হয়েছে সুপিন নালার সঙ্গে। তারপর নৈটোয়ারের কাছে সুপিন নালা মিলিত হয়েছে রুপিন নালার সঙ্গে। সৃষ্টি হয়েছে তমসা বা টনস নদীর। তালুকা থেকে হর-কি-দূন অভিমুখে চলার পথে তমসার দেখা পাওয়া যায় না। হর-কি-দূন নালাটিকে বাঁ দিকে রেখে অল্প অল্প চড়াইপথ। নদীর ও পারে গঙ্গার গ্রামটিকে দেখা যাবে। বনের মধ্যে পাকদণ্ডী চড়াই পথে উঠে আসবেন পূর্ব দিক থেকে নেমে আসা সিয়াং নালার ধারে। নালাটি পেরিয়ে খানিকটা এগিয়ে পথের পাশে একটি চায়ের দোকান দেখতে পাবেন। এই ছোট্ট গ্রামটি ছাড়িয়ে প্রায় সমতল পথে পৌঁছে যাবেন সীমা গ্রামে।
জিএমভিএন-এর বাংলো ও ফরেস্ট রেস্ট হাউস আছে। আছে বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান। নদীর ও পারে ওসলা গ্রাম। সরাসরি নয়, অনেকটা ঘুরপথে ওখানে পৌঁছন যায়।
দ্বিতীয় দিন সীমা-কলকত্তি ধার-হর-কি-দূন (৩৫৬৬ মি)-১১ কিমি
নিরিবিলি সীমা গ্রাম...
সীমা গ্রাম থেকে নেমে আসতে হবে হর–কি-দূন নালার ধারে। চলে আসবেন একটা পুলের কাছে। এখান থেকে দু’টি পথ। নদীর বামপথ ধরে পথ চলে যায় রুইসারা তালাও হয়ে ধুমধার কান্দি অভিমুখে। ওপথে নয়। চলে আসুন নদীর ডানতটে। পুল পেরিয়ে আবার দু’টি পথ। পশ্চিমমুখী পথ চলে যায় ওসলা গ্রামের দিকে। পূর্বমুখী পথে এগিয়ে চলুন হর-কি-দূন অভিমুখে। অল্প অল্প চড়াইপথ। হর-কি-দূন নদীর প্রবাহ থাকবে ডান দিকে অনেকটা দূরে।
আরও পড়ুন: পায়ে হেঁটে গাড়োয়াল হিমালয়ের বাগিনি হিমবাহের অন্দরে
বাঁ দিক থেকে নেমে আসা একটা নালা পেরিয়ে উঠে আসবেন কলকত্তি ধার। এর পর হালকা অরণ্যের মাঝে ছোট ছোট বুগিয়াল অঞ্চল। বাঁ দিক থেকে নেমে আসা আরও একটি নালা পেরিয়ে চলে আসবেন ঘাস ও গুল্মে ভরা ময়দানের মাঝে নদীর কাছে। এক সময় চলে আসবেন মাতা-কি-গাডের ধারে। পুল পেরিয়ে উঠে আসতে হবে হর-কি-দূনের আস্তানায়। যমদ্বার হিমবাহ সমেত স্বর্গারোহিণী-২ শৃঙ্গটিকে দেখা যাবে।
তৃতীয় দিন হর-কি-দূন-যমদ্বার হিমবাহ-মারিন্দর তাল-হর-কি-দুন
খুব ভোরে চলে আসুন যমদ্বার হিমবাহের মাঝে। স্বর্গারোহিণী শৃঙ্গমালাকে আরও কাছ থেকে দেখা যাবে। ফিরে আসুন হর-কি-দূন। তারপর মাতা-কি-গাড পেরিয়ে মারিন্দর নালার ধারে ধারে পৌঁছে যাবেন মারিন্দর তালের কাছে। ছোট্ট এই সরোবরটি দেখে ফিরে আসুন হর-কি-দূনের আস্তানায়।
চতুর্থ দিন হর-কি-দূন-ওসলা (৩৩০৮ মি.)-সীমা
একই পথে নেমে আসবেন ওসলা গ্রামে। এ গ্রামের আরাধ্য দেবতা হল কুরু বংশের অধিপতি দুর্যোধন। দুর্যোধনের মন্দির ও সেইসঙ্গে গ্রামটিকে দেখে চলে আসবেন সীমা।
তালুকার সৌন্দর্য মন ভরিয়ে দেয়।
পঞ্চম দিন সীমা-তালুকা
অল্প অল্প উতরাই পথে চলে আসবেন একটি নালার ধারে। নালাটি পেরিয়ে বনের মধ্যে গিয়ে সরাসরি নেমে আসতে হবে হর-কি-দূন নালার কাছে। তারপর ওঠা-নামা পথে দুপুরের মধ্যেই তালুকা ফিরে আসতে পারবেন। তালুকা থেকে হাঁটাপথে বা গাড়ি চেপে সে দিনই শাঁকরি ফিরে আসবেন।
এ পথের জন্য মালবাহক বা পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয় না। সর্বত্রই থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। মালবাহক নিতে হলে শাঁকরি পোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। দল বড় হলে মাল পরিবহণের জন্য খচ্চর নেওয়াই ভাল।
শাঁকরি ও তালুকার মাঝে খানিকটা অংশে প্রায়শই ধস নামার ফলে রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে মাঝেমধ্যে বেশ খানিকটা পথ বাড়তি হাঁটতে হয়। তখন শাঁকরি থেকেই হাঁটতে হবে।
(লেখক পরিচিতি: আক্ষরিক অর্থেই রতনলাল বিশ্বাস ভূপর্যটক। তাঁর ট্রেকিংয়ের শুরু সেই ১৯৭২ সালে। ট্রেকিংয়ে সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন তিনি। এ পর্যন্ত মোট ১০১টি ট্রেকিং সম্পন্ন। ব্যাঙ্কে না ঢুকে পূর্ব রেলে চাকরি নিয়েছিলেন বেড়ানোর নেশায়। শুধু পাহাড়েই নয়, গঙ্গাসাগর থেকে হেঁটে মুম্বইয়ে আরব সাগরের উপকূল পর্যন্ত পৌঁছেছেন রতনলাল, সে যাত্রায় পেরিয়েছেন প্রায় চার হাজার কিলোমিটার। হেঁটেছেন শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ উপকূল ধরেও। ’৭৮ সাল থেকে নেপালে ট্রেক করেছেন পর পর ২৫ বছর। ’৮৭ থেকে ৩০ বছর ধরে যাচ্ছেন লাদাখে। এ পর্যন্ত ট্রেকিং পথ পেরিয়েছেন প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার। পাশাপাশি চলেছে নিরন্তর ক্যামেরার লেন্সে চোখ রাখা। এ পর্যন্ত লিখেছেন ভ্রমণ সংক্রান্ত আটটি গ্রন্থ। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন বছর তিনেক। কিন্তু পদব্রজে বিশ্ব পরিক্রমার নেশা থেকে অবসর নেবেন, এমনটা স্বপ্নেও ভাবেন না রতনলাল।)