সাগর-পাহাড়ের এমন মেলনব্ধন দেখতে চলুন বিশাখাপত্তনমে। ছবি: সংগৃহীত।
সমুদ্র একই, কিন্তু তার রূপ আলাদা। পাশাপাশি দুই রাজ্য ওড়িশা এবং অন্ধ্রপ্রদেশ। বঙ্গোপসাগরই রয়েছে দুই স্থানে। অথচ তার রূপের ফারাক অনেকটাই। বিশাখাপত্তনমের সৈকতের ভোল পাল্টে দেয় পাহাড়ের উপস্থিতি। ঢেউ যখন সেই পাথুরে তটে আছড়ে পড়ে— বদলে যায় রূপ।
ওড়িশার সৈকত শহর পুরী বাঙালির চিরকালীন পছন্দের স্থান। তবে এ বার যদি চেনা সাগরকে একটু অন্য ভাবে দেখতে চান, গাড়ি ছোটাতে চান সমুদ্রকে পাশে রেখে পিচঢালা মসৃণ সড়কে, চলুন বিশাখাপত্তনম।
কলকাতা থেকে সড়কপথে বিশাখাপত্তনমের দূরত্ব চেন্নাই-কলকাতা হাইওয়ে দিয়ে গেলে ৮৮০ কিলোমিটার। লম্বা যাত্রাপথ মোটেই ক্লান্তিকর হবে না যদি সফরের পরিকল্পনা সঠিক হয়। হাতে দিন সাত-আট ছুটি থাকলেই সুন্দর ভাবে সাজিয়ে ফেলতে পারেন সফর।
কলকাতা থেকে ওড়িশা হয়ে বিশাখাপত্তনম। খড়্গপুর, বালেশ্বর, কটক, ভুবনেশ্বর হয়ে পথ এগিয়েছে। মসৃণ রাস্তায় যানজটে আটকে না পড়লে ভুবনেশ্বর পৌঁছতে সময় লাগবে ঘণ্টা আটেক। সময় বাঁচাতে রাতেও যাত্রা শুরু করতে পারেন। তা হলে মাঝেমধ্যে আধ ঘণ্টা করে চা-বিরতি নিলেও সকালবেলাই পৌঁছনো যাবে ভুবনেশ্বর। সেখানে বেশ কিছু ক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, প্রাতরাশ করে গাড়ি ছোটান। ইচ্ছা হলে পথেই দেখে নিতে পারেন লিঙ্গরাজ মন্দির, তাপাং (খোলামুখ খনিতে জল জমে হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে এখানে)। ভুবনেশ্বর থেকে চলুন বরকুল। ওড়িশার এই জায়গাটি থেকে চিল্কার সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। বিকেলবেলা চিল্কার ধারে দারুণ সময় কাটাতে পারেন। উপহ্রদটির গায়েই ওড়িশা সরকারের পান্থনিবাস। লম্বা সফরের পর ঘোরা এবং বিশ্রাম দুই-ই হবে এখানে রাতটা থেকে গেলে।
চিল্কার বুকে কালীযাই দ্বীপে রয়েছে কালীযাই মন্দির। ছবি: সংগৃহীত।
বরকুল থেকে যন্ত্রচালিত নৌকো করে ঘুরে নেওয়া যায় কালীযাই মন্দির। দ্বীপের মধ্যে মন্দির। যাত্রাপথে সঙ্গ দেয় পাখিরা। দারুণ উপভোগ্য জলপথ। সকালে কালীযাই ঘুরে প্রাতরাশ সেরে ফের যাত্রা শুরু করুন।
এবার গন্তব্য বিশাখাপত্তনম। দূরত্ব ৩৩৮ কিলোমিটার। মধ্যাহ্নভোজ এবং শরীরের আড় ভাঙার জন্য বার দুই-তিন বিরতি নিলেও সন্ধ্যায় পৌঁছে যাওয়া সম্ভব সৈকত শহরে। বিশাখাপত্তনম শহরটি বেশ সাজানো-গোছোনা। রুশিকোন্ডা, ইয়াড়াদা, রামকৃষ্ণ, গঙ্গাভরম— অসংখ্য সৈকত রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সৈকতগুলিকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে হোটেল-রিসর্ট। এক দিকে সমুদ্র, তার পাশ দিয়েই গিয়েছে পিচের মসৃণ রাস্তা। এই শহরে নিজে গাড়়ি চালানো বা গাড়িতে একেবারে নিজের মতো করে ঘোরার আনন্দই আলাদা।
রোড ট্রিপের আনন্দ পথ চলাতেই। নিজের গাড়িতে যাওয়া মানে যেখানে ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা থমকে যাওয়া। কোনও জায়গা চাইলে বাদ দেওয়া। এই স্বাধীনতাটুকুই এমন সফরের বাড়তি পাওনা। রাতটা শরীরকে বিশ্রাম দিয়ে বিশাখাপত্তনম ঘুরে নিন পরের দিন সকাল থেকেই।
শুরুটা করতে পারেন সিংহাচলম মন্দির দিয়ে। সাগরের সৌন্দর্যের পাশাপাশি পাহাড়ি পথের শোভাও মিলবে। পাহাড় ঘিরে রেখেছে এই স্থান। এখানে পূজিত হন বিষ্ণুর নরসিংহ বা নৃসিংহ অবতার। মন্দির দেখে চলুন ২৪ কিলোমিটার দূরের থোতলাকোন্ডা সৈকতে। এই স্থানে রয়েছে বৌদ্ধস্তূপ। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, নিরালা সৈকতে দেখা যায় প্রাকৃতিক আর্ক বা খিলান। সমুদ্র এবং বায়ুর ক্ষয়কাজের ফলে তৈরি ভূমিরূপই এখানকার সৌন্দর্যের বিশেষত্ব।
থোতলাকোন্ডা সৈকতে ‘ন্যাচারাল আর্ক’। ছবি:সংগৃহীত।
সমুদ্রের ধার বরাবর রাস্তা। সেখান দিয়ে গাড়ি ছোটালে মিনিট পনেরোতেই পৌঁছে যাওয়া যায় আর জনপ্রিয় সৈকত রুশিকোন্ডায়। পাহাড়-সাগরের মেলবন্ধন চোখে পড়বে এখানে। স্পিডবোটে চাপার সুযোগ রয়েছে।
রুশিকোন্ডা থেকে সাবমেরিন মিউজ়িয়ামের দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। সাবমেরিনের ভিতরটা দেখে নিতে পারবেন এখানে। এই সুযোগ যে কোনও জায়গায় মেলে না।
বিশাখাপত্তনমে ঘুরে নিন ইয়াড়দা সৈকতও। ছবি:সংগৃহীত।
বিশাখাপত্তনমে এসে কৈলাসগিরি বাদ দিলে চলবে না। পাহাড়ের মাথায় শিব-পার্বতীর মূর্তি। এই স্থানের বিশেষত্ব হল পাহাড়ের উপর থেকে সাগর দেখা। সূর্যাস্ত ভীষণ সুন্দর দেখা যায়। এক সময়ে এই স্থানে অসংখ্য হিন্দি এবং বাংলা ছবির শুটিং হয়েছে। কৈলাসগিরির সৌন্দর্য উপভোগ করতে টয়ট্রেনে চড়ে বসুন। রোপওয়ে থেকেও সমুদ্র-পাহাড়ের দারুণ ভিউ মেলে। ভাল হয় এই জায়গাটি আলাদা ভাবে বাড়তি সময় নিয়ে বিকালে ঘুরলে। সন্ধ্যাতেও বেশ উপভোগ্য স্থানটি।
কৈলাসগিরি থেকে দারুণ ভিউ পাওয়া যায় সাগর এবং পাহাড়ের। ছবি: সংগৃহীত।
চাইলে আরও একটি দিন সৈকত শহরে কাটাতে পারেন। সমুদ্রস্নান করতে পারেন। আরও কয়েকটি সৈকতে সময় কাটাতে পারেন। এতে লম্বা যাত্রার ধকলও খানিক কমবে।
চতুর্থ দিন বা পঞ্চম দিন সকালে বিশাখাপত্তনম থেকে আরাকুভ্যালি হয়ে চলুন জগদলপুরে। আরাকুভ্যালি যাওয়ার রাস্তাটি দারুণ। সাড়ে তিন ঘণ্টায় সেই উপত্যকায় পৌঁছে যাবেন। এখানে রয়েছে মিউজ়িয়াম এবং কয়েকটি দর্শনীয় স্থান। সেগুলি ঘুরতে ঘুরতেই চলুন জগদলপুর। দূরত্ব বিশাখাপত্তনম থেকে ২৯৮ কিলোমিটার। পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।
ছত্তীশগঢ়ের বস্তার জেলায় অবস্থান জগদলপুরের। অরণ্য-জলপ্রপাত এই স্থানের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। জগদলপুর থেকে পরের দিন ঘুরে নিন চিত্রকোট জলপ্রপাত। ইন্দ্রাবতী নদী থেকেই জন্ম চিত্রকোটের। সৌন্দর্যের জন্য জলপ্রপাতটিকে ‘নায়াগ্রা’-র তুলনা করা হয়। তিরথগড় জলপ্রপাতটিও বেশ জনপ্রিয় পর্যটনস্থল। এ ছাড়াও দেখে নিতে পারেন আরও তিনটি জলপ্রপাত। তামড়া ঘুমর, মণ্ডবা ও চিত্রধারা।
জগদলপুরের চিত্রকোট জলপ্রপাত। ছবি: সংগৃহীত।
জগদলপুরে দু’রাত কাটিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে ফেরার জন্য। এই দিনটি লম্বা সফর করে চলে আসুন কেওনঝর। ৬০০ কিলোমিটার রাস্তা আসতে ১৩ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। কেওনঝরে একাধিক জলপ্রপাত রয়েছে। সম্ভব হলে পরের দিন কলকাতা যাওয়ার সময় তার দু-একটি দেখে নিতে পারেন। কেওনঝর থেকে কলকাতার দূরত্ব ৩৩৩ কিলোমিটার। মোটমুটি ৮-৯ ঘণ্টা সময় লাগবে ফিরতে।
কী ভাবে যাবেন?
কেউ একটানা ১৬-১৭ ঘণ্টা সফর করে সরাসরি গন্তব্যে পৌঁছতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কেউ চান ঘুরতে ঘুরতে বিশ্রাম নিয়ে যেতে। যার যেমন পছন্দ, সেই ভাবে সফর সাজাতে পারেন। কলকাতা থেকে বিশাখাপত্তনমের দূরত্ব ভুবনেশ্বর, কটক, বরকুল হয়ে গেলে ৮৮০ কিলোমিটার। ফেরার সময় একই পথ না ধরে জগদলপুর থেকে ফিরুন। পথে কেওনঝরে রাতটা কাটিয়ে নিন। জদগলপুর থেকে কলকাতার দূরত্ব ৯৮৬ কিলোমিটার। জগদলপুর যেতে না চাইলে ওড়িশার রম্ভা, কটক, ভুবনেশ্বর হয়ে ফিরুন। এর মধ্যে যে কোন একটি জায়গায় এক রাত থেকে আশপাশ ঘুরেও নিতে পারেন।
কোথায় থাকবেন?
বিশাখাপত্তনমে অসংখ্য হোটেল, রিসর্ট রয়েছে। জগদলপুরেও থাকার জায়গার অভাব নেই। বিভিন্ন দামের এবং মানের হোটেল পাবেন।