পাকিস্তানি গুপ্তচরদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন ভারতীয় নেটপ্রভাবী ইউটিউবার জ্যোতি মলহোত্রা। হরিয়ানার বাসিন্দা জ্যোতি ইউটিউবে মূলত ভ্রমণের ভিডিয়ো পোস্ট করতেন।
পাকিস্তানি গুপ্তচরদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগে সেই জ্যোতিই এখন তদন্তকারীদের নিশানায়। জ্যোতি-কাণ্ড ইতিমধ্যেই দেশ জুড়ে হইচই ফেলেছে। প্রতিনিয়ত উঠে আসছে নতুন নতুন তথ্য। এর মধ্যেই জানা গিয়েছে, গত বছর রাজস্থানে গিয়ে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকা ঘুরে দেখেন জ্যোতি। সেখানে গিয়ে একাধিক ভিডিয়ো শুট করেছিলেন। সেই ভিডিয়োয় তাঁকে স্থানীয়দের পাকিস্তান সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করতে দেখা গিয়েছিল।
সূত্রের খবর, রাজস্থানে গিয়ে ভারত-পাক সীমান্তবর্তী এমন কিছু এলাকায় জ্যোতি গিয়েছিলেন যেখানে সাধারণের যাওয়া নিষিদ্ধ। জানা গিয়েছে, গত বছরের জানুয়ারিতে বাড়মের থেকে যাত্রা শুরু করেন জ্যোতি। ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত থেকে মাত্র দু’কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মুনাবাও গ্রামে পৌঁছোন তিনি।
মুনাবাও গ্রামে গিয়ে ২৪ মিনিটের একটি ভিডিয়ো শুট করেছিলেন জ্যোতি (যদিও সেই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার ডট কম)। অভিযোগ, সেই ভিডিয়োয় মুনাবাও স্টেশন-সহ ভারতীয় সেনার বেশ কিছু কৌশলগত অবস্থান প্রকাশ্যে আনেন নেটপ্রভাবী।
পাশাপাশি, সেই ভিডিয়োয় তাঁকে স্থানীয়দের পাকিস্তান সম্পর্কে প্রশ্ন করতে দেখা গিয়েছিল। পাকিস্তানে কারও আত্মীয় রয়েছেন কি না, তা নিয়ে স্থানীয়দের প্রশ্ন করেছিলেন তিনি। সীমান্তবর্তী কয়েকটি গ্রামে রাতও কাটিয়েছিলেন। অনুমতি ছাড়া বেশ কয়েকটি জায়গায় পরিদর্শনের অভিযোগও উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে।
মনে করা হচ্ছে রাজস্থানে তোলা সেই ভিডিয়ো জ্যোতির বিরুদ্ধে ‘চরবৃত্তি’র মামলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হয়ে উঠতে পারে। কারণ জ্যোতির তোলা সেই ভিডিয়ো পরিকল্পিত নজরদারির জন্য তোলা হয়েছিল কি না তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
সূত্রের খবর, জ্যোতি সত্যিই ভারত-পাক সীমান্তবর্তী এলাকার ‘রেকি’ করেছিলেন কি না এবং সেনার অবস্থান বা কাঁটাতারের অবস্থান ফাঁস করার জন্য ভিডিয়ো ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন কি না তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
পাকিস্তানি গুপ্তচরদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগে গত শুক্রবার গ্রেফতার হয়েছেন জ্যোতি। আপাতত আগামী ২৫ তারিখ পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতেই কাটাতে হবে হরিয়ানার ইউটিউবারকে। পহেলগাঁও কাণ্ডের পর থেকে পাকিস্তানি গুপ্তচরদের সঙ্গে ভারতীয়দের যোগাযোগের বেশ কিছু অভিযোগ উঠে এসেছে। গত কয়েক দিনে পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থান থেকে বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁদেরই এক জন জ্যোতি।
তদন্তকারীদের সন্দেহ, ভারতের বিভিন্ন স্থানের সংবেদনশীল তথ্য পাকিস্তানিদের কাছে পাচার করতেন জ্যোতি। তথ্য পাচার করতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থান এবং গতিবিধি সম্পর্কেও। হোয়াট্সঅ্যাপ, টেলিগ্রাম এবং স্ন্যাপচ্যাট ব্যবহার করে তিনি পাকিস্তানি চরেদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন বলে অভিযোগ।
অভিযোগ, পাকিস্তানি চরেদের পরিচয় গোপন রাখতে মোবাইলে অন্য নামে নম্বরগুলি সেভ করতেন জ্যোতি। তার মধ্যে ‘জাট রনধাওয়া’ নামে একটি নম্বর সেভ করা ছিল। তদন্তকারীদের সন্দেহ, ওই নম্বরটি আসলে পাকিস্তানি চর শাকিরের। এক পাকিস্তানি চরের সঙ্গে জ্যোতির ‘ঘনিষ্ঠতা’ তৈরি হয়েছিল বলেও তদন্তকারী দল সূত্রে খবর।
জ্যোতি যখন বালি এবং ইন্দোনেশিয়া ঘুরতে গিয়েছিলেন, সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে এক পাকিস্তানি চর ছিলেন বলে সন্দেহ তদন্তকারীদের। নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাই কমিশনের আধিকারিক এহসান-উর-রহিম ওরফে দানিশের সঙ্গে ধৃত ইউটিউবার জ্যোতির ‘ঘনিষ্ঠতা’ও এখন পুলিশের নজরে।
অভিযোগ, দানিশের মাধ্যমেই পাক গুপ্তচর সংস্থার একাধিক আধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল জ্যোতির। মোট দু’বার পাকিস্তান গিয়েছিলেন জ্যোতি। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, জ্যোতি প্রথম বার পাকিস্তান যান ২০২৩ সালে। ওই সময় নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাই কমিশনের আধিকারিক দানিশের সঙ্গে তাঁর পরিচয়।
জ্যোতির ইউটিউব চ্যানেলের নাম ‘ট্রাভেল উইথ জো’। সেখানে মূলত ভ্রমণের ভিডিয়োই পোস্ট করতেন জ্যোতি। গত বছর কাশ্মীরে গিয়েছিলেন। সেখানে ডাল হ্রদে শিকারায় তাঁর ঘোরার ভিডিয়োও রয়েছে। ট্রেনে করে শ্রীনগর থেকে বনিহাল যাওয়ার একটি ভিডিয়োও পোস্ট করেছিলেন ইউটিউবার। গত এপ্রিল মাসে পহেলগাঁও কাণ্ডের পরও জ্যোতি একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেছিলেন।
ইউটিউবার হিসাবে দ্রুত খ্যাতি এবং অর্থ উপার্জন করতে চেয়েছিলেন জ্যোতি। নিজের ক্ষেত্রের প্রতিযোগীদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। জ্যোতির ইউটিউব চ্যানেল ‘ট্র্যাভেল উইথ জো’-এর সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৩ লক্ষ ৮৫ হাজার। এই সংখ্যাটাই দ্রুত বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন। সে জন্য নিত্যনতুন বিষয়বস্তুর প্রয়োজন ছিল তাঁর।
মনে করা হচ্ছে, সেই সব বিষয়বস্তু জোগাড় করতে একাধিক বার পাকিস্তানে গিয়েছিলেন জ্যোতি। পুলিশ জানিয়েছে, সেই সূত্রে পাকিস্তানি চরদের কাছে ক্রমেই ‘সম্পদ’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
দেশ-বিদেশে গিয়ে বিলাসবহুল হোটেলে থাকতেন জ্যোতি। বিমানের বিজ়নেস ক্লাসে যাতায়াত করতেন। এত টাকা কী ভাবে তাঁর কাছে আসত? বিশেষ কেউ কি সেই খরচ জোগাতেন? সেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তদন্তকারীরা। পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই কি টাকা দিত জ্যোতিকে? তা-ও জানার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা।
জানা গিয়েছে, পাকিস্তানে থাকাকালীন বিভিন্ন জায়গায় অবাধে যাতায়াত করার অনুমতি পেয়েছিলেন জ্যোতি। এমনকি অনেক সংবেদনশীল এলাকাও তিনি পরিদর্শন করতেন। জ্যোতি সে দেশে থাকাকালীন পাক পুলিশ তাঁর জন্য ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল বলেও খবর।
জ্যোতির ইনস্টাগ্রাম এবং ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিয়ো ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, তিনি মাস দুয়েক আগে, অর্থাৎ পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় ২৬ জনের মৃত্যুর ঘটনার আগে পাকিস্তান গিয়েছিলেন।
অটারী-ওয়াঘা সীমান্ত পেরিয়ে ও পারে যাওয়া, লাহৌরের আনারকলি বাজার, পাক পঞ্জাবের কটাস রাজ মন্দির ঘুরে দেখার ভিডিয়োও রয়েছে জ্যোতির। পাকিস্তানের খাবার এবং ভারত-পাকিস্তানের সংস্কৃতির তুলনা করেও ভিডিয়ো বানিয়েছিলেন ইউটিউবার।
গত বছর চিন সফরে গিয়েও বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন নেটপ্রভাবী। উঠে এসেছিলেন সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে। ২০২৪ সালে চিন সফরে গিয়েছিলেন ৩৩ বছর বয়সি নেটপ্রভাবী। চিন ভ্রমণের বেশ কয়েকটি ভিডিয়ো শেয়ার করে নেটাগরিকদের কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন তিনি। চিনে গিয়ে নানা কাণ্ড ঘটানোর জন্য তাঁকে সে দেশে নিষিদ্ধ করা হয় বলেও খবর।
জ্যোতির পুরো বিষয়টি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করছেন তদন্তকারীরা। ২০ জনেরও বেশি নেটপ্রভাবী গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন বলেও তদন্তকারীরা মনে করছেন।