সন্ধে নামতেই সুনসান এই বাণিজ্যকেন্দ্র। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
সন্ধের পরে সুনসান পেট্রাপোল। আর তাই দোকানে টাকা-পয়সা রেখে আসার সাহস পান না ব্যবসায়ীরা। এ দিকে, দিনে লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেন চলে দেশের বৃহত্তম বন্দর পেট্রাপোলের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রগুলি থেকে। কিন্তু দিনের শেষে সেই সব নগদ টাকা সঙ্গে করেই বাড়ি ফেরেন ব্যবসায়ীরা। আবার সকালে বাড়ি থেকে বয়ে টাকা নিয়ে যেতে হয় দোকানে।
কেন এমন ব্যবস্থা? ব্যবসায়ীরা জানালেন, উপায় কিছু নেই। কে দেবে নিরাপত্তা! কিন্তু এ ভাবে লক্ষ লক্ষ নগদ টাকা রোজ সঙ্গে করে আনা-নেওয়া করা তো ঝুঁকির। কী আর করা যাবে, ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা ঢুকে বন্দরে তাণ্ডব চালাবে না, কে বলতে পারে সে কথা? তাই নিজেদের সম্পত্তি রক্ষা করতে হয় নিজেদেরই। বন্দর এলাকার বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতাস, বিএসএফ বন্দর এলাকায় সরাসরি খুব একটা কড়া নজরদারি চালায় না। বরং কাঁটাতার-লাগোয়া এলাকায় তাদের গতিবিধি অনেক বেশি। কাজেই বন্দর এলাকায় ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত লোকজন নিরাপত্তার অভাব বোধে করেন সব সময়েই। এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘পুলিশ-বিএসএফের ভরসায় থেকে লাভ নেই, সেটা আমরা বিলক্ষণ বুঝে নিয়েছি। যে কারণে, বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে বেরোনার সময়ে অন্য চেনা পরিচিত বা ব্যবসায়ীদের ডেকে নিই। ছোট দলে ভাগ হয়ে এগোই বন্দরের দিকে। ফেরার পথেও এই ব্যবস্থা।’’
বন্দরের সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউস কর্পোরেশনের গুদামে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা হামেশাই ঢুকে পড়ে চুরি করে পালায় বলে অভিযোগ। সম্প্রতি পেট্রাপোল বন্দরের একটি দোকান, মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রে চুরি হয়েছিল। ওই ঘটনাতেও বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরাই জড়িত বলে জানতে পারে পুলিশ।
পেট্রাপোল এখন বনগাঁ থানার অন্তর্গত। বন্দর এলাকা থেকে থানার দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার। কোনও ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ আসতেও অনেকটা সময় লেগে যায়। পেট্রাপোলে একটি পৃথক থানা তৈরির পরিকল্পনা আছে সরকারের। যতক্ষণ তা না হচ্ছে, দুশ্চিন্তা কমছে না মানুষজনের।
এই পরিস্থিতিতে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর এলাকায় দুষ্কৃতীদের রমরমা চলছে বলে অভিযোগ। বহু ক্ষেত্রেই বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা ঢুকে পেট্রাপোল-সহ বনগাঁ মহকুমার সীমান্ত এলাকায় তাণ্ডব চালায়। কয়েক বছর আগে পেট্রাপোলে মোটরবাইক চড়ে আসা দুষ্কৃতীরা যশোর রোডের উপরেই রশিদ মণ্ডল নামে এক ব্যক্তিকে খুন করে পালায়। ওই ঘটনায় বাংলাদেশিরা জড়িত ছিল বলে অনুমান।
পেট্রাপোল দিয়ে ঢুকে কিছু বাংলাদেশি জয়ন্তীপুরের বাসিন্দা মজনু মণ্ডলকে তাঁর বাড়ির সামনেই গুলি করে খুন করেছিল। পালানোর সময়ে বিএসএফ জওয়ানেরা বাধা দিলে তাদের উপরেও চড়াও হয়। আংরাইল সীমান্তে এক আরপিএফ জওয়ানকে কুপিয়ে খুন করে বাংলাদেশে পালিয়েছিল পড়শি দেশের দুষ্কৃতীরা। কুলিয়ায় ভয়াবহ ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছিল বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা।
এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ জানালেন, এই এলাকায় সোনা ও ধুর (মানুষ) পাচারের হাত ধরে বিকল্প অর্থনীতি চলে। গোটা বনগাঁয় সেই অর্থে শিল্প নেই। অবৈধ কারবারে জড়িয়ে পড়ে দু’পারের বহু লোকজনই। সেই কাজ সামলাতে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের কদর আছে। তাদের ডাকও পড়ে প্রায়শই। অমনি নিরাপত্তার ফাঁকফোঁকর গলে অনেকে সশস্ত্র অবস্থায় এ দেশে ঢুকে পড়ে ‘অ্যাকশন’ সেরে নিরাপদে ফিরেও যায় বাংলাদেশে।
পেট্রাপোল চেকপোস্ট ওয়েলফেয়ার ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক দীপক ঘোষ বলেন, ‘‘নিরাপত্তা বলতে এখানে কিছু নেই। যে কোনও দিন যে কারও জীবনটাই চলে যেতে পারে। উপায় না থাকায় প্রাণ হাতে করেই ব্যবসা করেন মানুষজন।’’ তাঁর দাবি, পেট্রাপোলে বহু বাড়িতে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা এসে আশ্রয় নেয়।
বন্দরের মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রের কর্মী বাপ্পা ঘোষের কথায়, ‘‘বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের ঢোকা আটকানো না গেলে আরও বড় ধরনের বিপদ যে কোনও দিন ঘটে যেতে পারে। আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি।’’
পেট্রাপোলের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সীমান্তে বিএসএফ থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা এখানে ঢুকে পড়ছে, সেটা আশ্চর্যের। পুলিশি টহলও সে ভাবে বেড়েছে বলে মনে করেন না এখানকার মানুষজন।
অতীতে পেট্রাপোল থেকে লস্কর-ই-তইবা জঙ্গি ধরা পড়েছে। ইতিমধ্যে পড়শি দেশে ঘটে গিয়েছে জঙ্গি হামলার ঘটনা। সে দেশে রমরমিয়ে বাড়ছে আইএস-এর কারবার। এই পরিস্থিতিতেও পেট্রাপোলে নিরাপত্তা বাড়ানোর ব্যাপারে পুলিশ-প্রশাসনের টনক না নড়ায় হতাশ সকলেই।