সিসিটিভিতে এ ভাবেই ধরা পড়ছে গোটা চত্বরের ছবি। —নিজস্ব চিত্র।
সোনাপাচার-সহ নাগাড়ে হয়ে চলা বেআইনি কাজ বন্ধ করতে এ বার ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসল দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর পেট্রাপোলে।
শুল্ক দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এলাকায় ৬টি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে। বন্দরের আন্তর্জাতিক গেটের সামনে একটি। যেখানে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ হয় (নো-ম্যান্স ল্যান্ড), সেখানে একটি। তা ছাড়াও তিনটি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে ‘ব্যাগেজ কাউন্টারে’। আর একটি ক্যামেরা বসানো হয়েছে শুল্ক দফতর ও অভিবাসন দফতরের মাঝখানে। আর পেট্রাপোল শুল্ক দফতরের ডেপুটি কমিশনার শুভেন দাশগুপ্তের ঘরে রয়েছে একটি মনিটর। তিনি অফিসে বসেই সে দিকে নজর রাখছেন।
শুভেনবাবু বলেন, “সোনা পাচার-সহ নানা বেআইনি কাজ বন্ধ করতে সিসি ক্যামেরাগুলো লাগানো হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য, বন্দরের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। ক্যামেরা বসানোর পর থেকে বেআইনি ভাবে আন্তর্জাতিক গেট ও শুল্ক দফতর এবং অভিবাসন দফতরের সামনে লোকজনের আনাগোনা অনেকটাই কমে গিয়েছে।” শুল্ক দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২৪ ঘণ্টা ওই ক্যামেরাগুলো সচল থাকে। সন্ধের পর অফিস বন্ধ হয়ে গেলেও পর দিন সকালে এসে ক্যামেরার ফুটেজ দেখা হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, রাতে বন্দর এলাকায় কোনও অনুপ্রবেশ বা বেআইনি কাজ হয়েছিল কিনা।
সম্প্রতি শুল্ক দফতরের পক্ষ থেকে আরও একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ভারত-বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের মধ্যে অবাধ যাতায়াতের উপরে নিয়ন্ত্রণ আনা হবে। যা নিয়ে কোনও কোনও সংগঠনের ক্ষোভ থাকলেও শুল্ক দফতর নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড়।
বন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই প্রশ্নচিহ্ন ছিল। উদ্বিগ্ন ছিলেন বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরাও। বন্দর এলাকায় একটি থানা তৈরির পরিকল্পনার কথা অতীতে কেন্দ্রের তরফে বলা হলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে দিন দুপুরে ঢুকে দুষ্কৃতীরা বন্দর এলাকায় খুন করে পালিয়ে গিয়েছে এমন ঘটনার একাধিক নজির রয়েছে। রাতে বাংলাদেশ থেকে ঢুকে সেন্ট্রাল ওয়্যার হাউস কর্পোরেশনের ট্রাক টার্মিনাসে থাকা পণ্যবাহী ট্রাক ভাঙচুর ও ট্রাক থেকে পণ্য চুরির ঘটনাও ঘটেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে সোনা পাচারের ঘটনার বেশ কিছু প্রমাণ মিলেছে। সোনার বাট ও বিস্কুট-সহ কয়েক জন পাচারকারীকে বিএসএফ এবং শুল্ক দফতর হাতেনাতে পাকড়াও করেছে। তাদের জেরা করে শুল্ক দফতরের আধিকারিকেরা জানতে পেরেছেন, দুবাই থেকে সোনার বিস্কুট নিয়ে ঢাকা হয়ে বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে ওই বিস্কুট এ দেশে ঢুকেছে।
কিন্তু বিএসএফ এবং শুল্ক দফতরের আধিকারিকদের উদ্বেগের কারণ অন্য জায়গায়। সোনার বিস্কুট-সহ ধরা পড়া পাচারকারীদের মধ্যে ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত কেউ কেউ। বাংলাদেশের ক্লিয়ারিং এজেন্ট ও এ দেশের ফরওয়ার্ডিং এজেন্টও গ্রেফতার হয়েছিলেন। যাঁরা বাণিজ্যের কারণ দেখিয়ে দু’দেশের মধ্যে অবাধে যাতায়াত করেন, তাঁদের অনেকেরই সরকারি বা সরকার অনুমোদিত বৈধ পরিচয়পত্র নেই। ওই ঘটনা সামনে আসতেই নড়ে বসেন বিএসএফ ও শুল্ক দফতরের কর্তারা।
এরপরেই বাণিজ্যিক কারণে দু’দেশের মধ্যে যাতায়াত করা এজেন্টদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্যোগী হয় বিএসএফ ও শুল্ক দফতর। কী ভাবে পেট্রাপোলের নিরাপত্তা বাড়িয়ে এজেন্টদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা নিয়ে গত জুন মাসে স্থানীয় হরিদাসপুরের বিএসএফ ক্যাম্পে শুল্ক দফতরের অপরাধ দমন শাখার কমিশনার ও বিএসএফের ডিআইজি যৌথ বৈঠক করেন। শুল্ক দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এখন থেকে শুল্ক দফতরের অনুমোদন ছাড়া কেউ বাংলাদেশে বাণিজ্যের কাজে অবাধে যাতায়াত করতে পারবেন না। ওই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় সিসি ক্যামেরা লাগানো হবে। তা ছাড়া, যে সব সংগঠনের প্রতিনিধিরা বেনাপোলে বাণিজ্যের জন্য যাতায়াত করেন, তাঁদের নামের তালিকা জমা দিতে হবে। শুল্ক দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, একমাত্র ক্লিয়ারিং এজেন্টদের সংগঠনের সদস্যেরাই শুল্ক দফতরের অনুমোদন নিয়ে যাতায়াত করেন। কিন্তু এমন সংগঠনও রয়েছে, যার কর্মীরা তাঁদের সংগঠনের সম্পাদক বা সভাপতির স্বাক্ষরযুক্ত কার্ড নিয়ে যাতায়াত করেন। শুল্ক দফতরের কর্তারা নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁদের অনুমোদন ছাড়া সীমান্তের ও পারে কেউ যেতে পারবেন না। তা ছাড়া, নির্দিষ্ট সংখ্যক লোককেই যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।
সীমান্তের মূল গেটের কাছে একটি চেকপোস্ট করা হয়েছে। যেখানে বিএসএফ এবং শুল্ক দফতরের এক জন করে অফিসার থাকবেন। তাঁরা উভয় দেশের মধ্যে যাতায়াতকারী এজেন্টদের যাবতীয় তথ্য নথিভুক্ত করবেন। নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসায়ীদের যাতায়াতও। পাসপোর্ট নিয়ে উভয় দেশে যাতায়াত করা যাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট করিডর তৈরি করা হয়েছে। শুভেনবাবু বলেন, “সিসি ক্যামেরা বসানো ও কিছু নিয়ম চালুর পরে নিরাপত্তা বেড়েছে বন্দর এলাকায়।” এতে খুশি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত বেশির ভাগ মানুষই।