বাওরে-বিয়ে: গাইঘাটায়। —নিজস্ব চিত্র।
পাড়ে দাঁড়িয়ে তখন জামার হাতা গুটিয়ে, নাকের পাটা ফুলিয়ে রাগে ফুঁসছেন মেয়ের বাড়ির লোকজন। তড়পাচ্ছেন আর বলছেন, ‘‘সাহস থাকে তো এ দিকে আয়।’’ কিন্তু তখন কে শোনে কার কথা। নৌকোয় চোখ বন্ধ করে মন্ত্রোচ্চারণে ব্যস্ত বর-কনে। ‘‘যদিদং হৃদয়ং তব..’’ বলতে বলতে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে পাড়ের দিকে তাকিয়ে ফের মন্ত্রে মন দিলেন পাত্র।
বুধবার দুপুরে গাইঘাটার পাঁচপোতায় বাওরে ভাসতে ভাসতে মালা বদল হল পাত্র-পাত্রীর। মহিলারা শাঁখ বাজালেন, উলুধ্বনি উঠল। সে সবের শব্দে চাপা পড়ল পাড়ে দাঁড়ানো মেয়ের বাড়ির লোকজনের হা-হুতাশের শব্দ। একটা সময়ে যখন বুঝে গেলেন, আর কিছু করার নেই, রাগে গোঁ গোঁ করতে করতেই তাঁরা বাড়ির পথ ধরলেন।
কিন্তু এ ভাবে বিয়ে করতে হল কেন তরুণ-তরুণীকে?
বছর দু’য়েক আগে হাবরা থানার মছলন্দপুরের মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল পাঁচপোতার বছর ছাব্বিশের যুবকের। দানা বাঁধে ভালবাসা। যুবকটি বেঙ্গালরুর বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। দূরত্ব কখনই ভালবাসার পথে অন্তরায় হয়নি। তরুণী শ্রীচৈতন্য কলেজে পড়াশোনা চালাতে চালাতেই ঠিক করে ফেলেন, বিয়ে যদি করতে হয় তো একেই।
কিন্তু মেয়ে একা ভাবলেই তো হল না। বাড়ির লোকের মত যে অন্যরকম! অভিভাবকেরা চাইছিলেন, দ্রুত মেয়েকে পাত্রস্থ করতে। ছেলেও দেখা হয়েছিল। তরুণী জানিয়ে দেন, স্নাতক না হয়ে বিয়ে করবেন না। কিন্তু তাতে বাড়ির লোকের মন গলেনি। সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন তাঁরা। মেয়েটি উপায় না দেখে শেষপর্যন্ত জানিয়েও ছিল তাঁর ভালবাসার কথা। তাতে উল্টে বিয়ের তোড়জোড় আরও বাড়িয়ে দেন আত্মীয়েরা।
প্রেমিককে সে কথা ফোনে না জানিয়ে উপায় ছিল না তরুণীর। ‘দুলহানিয়া’ নিয়ে যেতে মঙ্গলবার বাড়ি ফেরেন ‘দিলওয়ালে’ যুবক।
চিত্রনাট্যমাফিক বুধবার সকালে প্রেমিকা চলে আসেন প্রেমিকের বাড়িতে। কবে কখন বিয়ে হবে, তা অবশ্য তখনও প্ল্যান হয়নি। কিন্তু খোঁজ-খবর করতে করতে মেয়ের বাড়ির লোকজনও হাজির হয় সেখানে। যুবকটি পাড়া-প্রতিবেশীর সাহায্য চান। এক পরিচিতের বাড়িতে আত্মগোপন করেন যুগলে।
পাড়ার লোকজনই বিয়ের আয়োজন সেরে ফেলেন দ্রুত। কেনা হয় শাঁখা-সিঁদুর-শাড়ি-আলতা-টোপর। গাঁয়ের পুরুত মশাইকেও হাজির করানো হয়। শেষে সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেন, বিয়েটা দেওয়া হবে মাঝ-বাওরে, নৌকোয় ভাসতে ভাসতে। তাতে করে মেয়ের বাড়ির লোকজনের পিছু ছাড়ানো যাবে।
হলও তাই। মেয়ের আত্মীয়-স্বজনেরা যদি বা হাজির হন বাওড়ের পাড়ে, দ্বিতীয় কোনও নৌকো খুঁজে না পেয়ে পাড়ে দাঁড়িয়েই তর্জন গর্জন সেরে ফিরতে হয়েছে।
যুবকটি পরে বলেন, ‘‘আমি ওকে জোর করিনি। সিদ্ধান্ত নিতে বলেছিলাম। ও যখন বাড়ি ছেড়ে চলেই এল, তখন দ্রুত বিয়েটা সেরে ফেলার কথা ভাবি।’’ সদ্য কপালে সিঁদুর দেওয়া মেয়েটির মুখে তখন এক আকাশ আলো ছড়িয়ে। মুচকি হেসে বললেন, ‘‘ভাগ্যিস ঘাটে আর একটা নৌকো ছিল না!’’