চোরাগোপ্তা দিব্যি মেলে হরিণের মাংস

বন দফতর অভিযানও চালায়। মাঝে মধ্যে ধরা পড়ে কেউ কেউ। কিন্তু বিস্তীর্ণ জঙ্গল এলাকায় হরিণ মেরে মাংস বিক্রির কারবার যে বন্ধ হয়নি, সে কথা জানাচ্ছেন কুলতলির গ্রামের অনেকেই।

Advertisement

সমীরণ দাস

কুলতলি শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৩৭
Share:

বেড়াজাল: জঙ্গল ঘেরা জালে। যা টপকে চোরাশিকারিরা ঢুকে পড়ে ভিতরে। ছবি: সুমন সাহা

গাছের ডালে ঝোলে সরু তারের ফাঁস। এক-আধটা নয়। এক সঙ্গে বিশ-তিরিশটা।

Advertisement

জায়গাটা দেখেশুনেই বাছে চোরাশিকারির দল। জঙ্গলের মাঝে হরিণের দলের যাতায়াত সে সব জায়গা দিয়েই। অন্যমনস্ক হয়ে সে পথে হাঁটতে গিয়ে গলায় ফাঁস আটকে ছটফট করতে থাকে হরিণ। এক সময়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সময় বুঝে শিকারিরা এসে পিটিয়ে-কুপিয়ে খুন করে সেই হরিণ। ছাল ছাড়িয়ে মাংস বিক্রি হয়ে যায় গ্রামের হাটে-বাজারে।

তবে কারবারেক পুরোটাই চলে চোরাগোপ্তা। স্থানীয় মানুষজন অনেকেই জানেন সে কথা। তাঁরাই জানালেন, অপরিচিত মুখ হলে হরিণের মাংস বেরই করবে না কারবারিরা। ‘সোর্স’ মারফত এলে ঝুলি থেকে বেরোবে মাংস। ৫০০ টাকা কেজি দর হাঁকে কারবারিরা। তবে একটু দরদাম করে কিনতে পারলে সাড়ে তিনশো-চারশোতেও মিলে যায়। প্রাচীন চর্যাপদে কবি লিখেছিলেন, ‘‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’’— নিজের মাংসের জন্যই নিজের বিপদ ডেকে আনে হরিণ। সেই ঘটনারই সাক্ষী সুন্দরবনের বহু গ্রাম। যেখানে চোরাগোপ্তা হরিণ শিকারের কথা গ্রামের লোকের অজানা নয়। ‘সুস্বাদু’ হিসাবে নামডাক থাকায় হরিণের মাংস কেনার ক্রেতার অভাব পড়ে না।

Advertisement

আজ কোথায় কোথায় ভোট, দেখে নিন

বন দফতর অভিযানও চালায়। মাঝে মধ্যে ধরা পড়ে কেউ কেউ। কিন্তু বিস্তীর্ণ জঙ্গল এলাকায় হরিণ মেরে মাংস বিক্রির কারবার যে বন্ধ হয়নি, সে কথা জানাচ্ছেন কুলতলির গ্রামের অনেকেই। দিন কয়েক আগে হরিণের জন্য পাতা ফাঁদে আটকেই বাঘের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে এখানে। বাঘের দেহের সঙ্গে ফাঁসের তারও মিলেছে বলে জানিয়েছেন বন কর্তারা। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানান জেলা বনাধিকারিক সন্তোষ জিআর। তিনি বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। শীঘ্রই অপরাধীরা ধরা পড়বে।’’

তবে দু’চার বার ধরা পড়লেও হরিণের মাংসের গোপন কারবার পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে কিনা, সে প্রশ্নটাই এখন ঘুরছে সুন্দরবনের গ্রামেগঞ্জে।

কুলতলির গুড়গড়িয়া ভুবনেশ্বরী পঞ্চায়েতের মধ্য গুড়গুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এলাকায় চোরাশিকার হয় নিয়মিতই। কার্তিক দিন্দা, ভীষ্মদেব সাউ, সুভাষ মণ্ডলরা বলেন, ‘‘গ্রামের অনেকেই জানে কাদের কাছে হরিণের মাংস পাওয়া যায়।’’ মঙ্গলবার বাঘের দেহ উদ্ধারের পরে বুধবার দিনভর তৎপর ছিল বন দফতর। অধিকারিকদের নেতৃত্বে একটি দল বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায়। দফতর সূত্রের খবর, বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মধ্য গুড়গুড়িয়া গ্রামের ধার ধরে বয়ে গিয়েছে ঠাকুরান নদী। নদীর এক পাড়ে বসতি। অন্য পাড় ধরে জঙ্গল। মূল নদী আর জঙ্গলের মাঝামাঝি মোটা দড়ির জাল দিয়ে বেড়া দিয়ে রেখেছে বনদফতর। জঙ্গলের জন্তু জানোয়ার যাতে নদী পেরিয়ে গ্রামে ঢুকে না পড়ে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু অভিযোগ, বন দফতরের অনুমতি ছাড়াই জঙ্গলের ভেতরে ঢোকে অনেকে। হরিণও মারে কেউ কেউ। নলগড়া, চুপরিঝাড়া-সহ কুলতলির বিভিন্ন এলাকায় মাংস পাচার হয় বলে জানালেন স্থানীয় মানুষজন। চেনাশোনা সূত্র ধরে কলকাতা থেকেও অনেকে এসে নিয়ে যান সুস্বাদু বলে পরিচিত হরিণের মাংস। স্থানীয় বাসিন্দা পিন্টু মণ্ডল জানান, বছর দেড়েক আগে মধ্য গুড়গুড়িয়ায় হরিণের মাংস বিক্রি করতে গিয়ে বন দফতরের হাতে ধরা পড়েকয়েকজন। কিন্তু সে ভাবে শাস্তি হয়নি কারও। জয়নগরের বাসিন্দা, পশুপ্রেমী অরবিন্দ সর্দারের কথায়, ‘‘বাঘের চোরাশিকারটা হয়তো আর নেই। কিন্তু হরিণ মারা চলছেই। অনেক জায়গায় মাছ-কাঁকড়া ধরার নাম করে জঙ্গলে ঢুকে লোক হরিণ মেরে এনে বিক্রি করছে।’’ চোরাশিকার রুখতে তাঁরা নিয়মিত জঙ্গলে অভিযান চালান বলে অবশ্য দাবি করছেন বনকর্তারা। জঙ্গলের পশু মারার ঘটনায় কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা হয়। কম করে ৭ বছর পর্যন্ত হাজতবাস হতে পারে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

এক সময়ে মাংসের পাশাপাশি চামড়াও পাচার হত। ইদানীং সেই কারবারে রাশ পড়েছে। বাসিন্দাদের অনুমান, সে জন্যই ফাঁদে আস্ত বাঘ ধরা পড়ার পরেও তার চামড়া ছাড়িয়ে নেয়নি পাচারকারীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন