স্বস্তির পথে গোঁজের কাঁটা, মানতে নারাজ তৃণমূল

ধাক্কাটা প্রথম এসেছিল ২০০৯ সালে, লোকসভা নির্বাচনে। তৎকালীন বামফ্রন্টের ‘লাল দুর্গ’ ব্যারাকপুর পুরসভায় সেই প্রথম বড়সড় আঘাত হানে তৃণমূল। হেরে যান সিপিএমের ডাকসাইটে সাংসদ তড়িৎ তোপদার। তার পরে ২০১০-এর পুরভোট। যে পুরসভার সবক’টি ওয়ার্ডই ছিল বামেদের দখলে, তার অধের্কের বেশিতেই হেরে গেল তারা। পুর-বোর্ডে ক্ষমতায় এল তৃণমূল। তার পরে ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচন কিংবা ২০১৪-র লোকসভা ভোট, সবেতেই সবুজের জোয়ারে ধুয়েমুছে সাফ লাল।

Advertisement

বিতান ভট্টাচার্য

ব্যারাকপুর শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৫ ০১:৩৪
Share:

ধাক্কাটা প্রথম এসেছিল ২০০৯ সালে, লোকসভা নির্বাচনে। তৎকালীন বামফ্রন্টের ‘লাল দুর্গ’ ব্যারাকপুর পুরসভায় সেই প্রথম বড়সড় আঘাত হানে তৃণমূল। হেরে যান সিপিএমের ডাকসাইটে সাংসদ তড়িৎ তোপদার। তার পরে ২০১০-এর পুরভোট। যে পুরসভার সবক’টি ওয়ার্ডই ছিল বামেদের দখলে, তার অধের্কের বেশিতেই হেরে গেল তারা। পুর-বোর্ডে ক্ষমতায় এল তৃণমূল। তার পরে ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচন কিংবা ২০১৪-র লোকসভা ভোট, সবেতেই সবুজের জোয়ারে ধুয়েমুছে সাফ লাল। ফলে ২০১৫-র পুরসভা ভোটেও ব্যারাকপুরে জোড়াফুলই যে আপাত ভাবে সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে, তা ভাবা স্বাভাবিক। কিন্তু ‘অল ইজ নট ওয়েল’। কারণ, ২৫টি ওয়ার্ডের ১৬টিতেই গোঁজের খোঁচা।

Advertisement

২০১০-এর পুর-নির্বাচনের আগে তৃণমূল যখন ছোট ছোট পথসভা, মিটিং-মিছিল করছে, ‘লাল’গড় অটুট রাখতে তখন আনন্দপুরী খেলার মাঠে সভা করেন খোদ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, প্রকাশ কারাটেরা। পুরভোটের ফলে অবশ্য তার ছাপ পড়েনি। বামেদের নিরঙ্কুশ পুরবোর্ড ভেঙে ২৪টি ওয়ার্ডের ১৫টিই যায় তৃণমূলের দখলে। কংগ্রেস জেতে ৪টিতে। মাত্র ৫টিতে নিজেদের দখল কায়েম রাখতে পারে বামেরা। কিছু কাউন্সিলর দলবদল করায় তৃণমূলের দখলে আসে ১৮টি ওয়ার্ড, সিপিএমের ৫টি এবং একটি ওয়ার্ড পায় বিজেপি।

এর পরে বিধানসভা ও লোকসভা ভোট পেরিয়ে তৈরি মঞ্চে ২০১৫-র পুর-নির্বাচন। তবু তৃণমূলের নিশ্চিন্তে জয়ের ভাবনাতেই খানিকটা ছায়া ফেলছে গোঁজ প্রার্থী এবং বিজেপি-র ভোট কাটার চিন্তা। এ বারই প্রথম ব্যারাকপুর পুরসভার ২৪টির মধ্যে ১৬টি ওয়ার্ডে ব্যারাকপুর শহর তৃণমূল কংগ্রেস বাঁচাও কমিটির নামে জোড়া পাতা চিহ্নে দাঁড়িয়েছেন নির্দল প্রার্থীরা। তার মধ্যে বিদায়ী বোর্ডের তৃণমূল কাউন্সিলরেরাও আছেন। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের নিচুতলায় কর্মীদের মধ্যেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। দলকে সমর্থন করা হবে নাকি কাছের মানুষটিকে?

Advertisement

ব্যারাকপুর শহর তৃণমূল কংগ্রেস বাঁচাও কমিটির আহ্বায়ক ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী তৃণমূল কাউন্সিলর মিলনকৃষ্ণ আশ। নিজের ওয়ার্ডটি মহিলা-সংরক্ষিত হওয়ার পরে টিকিট না পেয়ে এ বার পাশের ৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর তথা কমিটির ক্ষোভ, নিচুতলার কর্মীরা নিজেদের সর্বেসর্বা ভাবতে থাকায় দলের মধ্যে সংঘাত তৈরি হয়েছে।

তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পর্যবেক্ষক নির্মল ঘোষ বলেন, ‘‘এ সব বাঁচাও কমিটি কোনও ব্যাপার নয়। মানুষ ভোট দেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে। তাই নির্দল বা গোঁজ প্রার্থী নিয়ে আমরা চিন্তিত নই।’’ স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রের খবর, মিলনবাবু-সহ মোট ৬ জন বিদায়ী কাউন্সিলরকে এ বার টিকিট দেয়নি তৃণমূল। শোনা যাচ্ছে, ব্যারাকপুরের স্থানীয় বিধায়ক শীলভদ্র দত্তের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মুখ খোলায় প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরাই টিকিট না পাওয়ায় দানা বেঁধেছে ক্ষোভ। তৃণমূল কংগ্রেস বাঁচাও কমিটি গড়ে নির্দল হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন ছ’জনেই। এবং ওই ছ’টি ওয়ার্ডই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব।

গত বারের তুলনায় এ বার ভোট কঠিন হলেও তাদের এগিয়ে থাকার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে করছে তৃণমূল। নিমর্লবাবুর দাবি, এ বার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে দল। তবে সিপিএম, বিজেপি বা কংগ্রেস সকলেই তা মানতে নারাজ। দ্বিতীয় বিরোধী শক্তি হিসেবে এ বারও ব্যারাকপুরে সিপিএম এগিয়ে আছে। সবক’টি ওয়ার্ডেই প্রার্থী দিয়েছে তারা।

২০১১-র নিরিখে বিজেপি প্রথম বার এগিয়ে ছিল ১৮, ২০ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডে। সিপিএম এগিয়েছিল ১৩ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে। এমনিতেও ১৩ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ড দু’টি বিদায়ী বোর্ডে সিপিএমের জেতা ওয়ার্ড ছিল। নির্বাচনের দিন ঘোষণার পর থেকেই বিরোধীরা তৃণমূলী সন্ত্রাস ও হামলার অভিযোগ করছেন। তবে বিজেপি ও গোঁজের দৌলতেই সিপিএম এ বার ব্যারাকপুরে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে। তবে সিপিএমের অভিযোগ, রাস্তায় দাঁড়িয়ে পতাকা লাগালে বা কোথাও কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করলেই তৃণমূলের বাইকবাহিনী হইহল্লা করে হাজির হয়ে মারধর করছে। পতাকা, ফেস্টুন কেড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। ভোট চাইতে যাওয়া দূরের কথা প্রকাশ্যে মুখ খুললেই হুমকি আর ঘাড় ধাক্কা জুটছে। তড়িৎবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘২০১০-এর সমীকরণ এ বার খাটবে না কারণ তৃণমূলের অভ্যম্তরীণ লড়াইয়ের ফল ১৬টি ওয়ার্ডে গোঁজ প্রার্থী। তার উপরে বিজেপি আছে। এতে আমাদেরই লাভ হবে।’’

বিজেপি প্রার্থী দিয়েছে মোট ২০টি ওয়ার্ডে। ৯, ১০ ১৪ ও ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে তারা প্রার্থী দিতে পারেনি। দলের জেলা সভাপতি অশোক দাসের কথায়, ‘‘তৃণমূল সন্ত্রাস করে আমাদের আটকাতে চাইলেও আমরা কিছু ওয়ার্ডে ভাল ফল করব।’’ কংগ্রেস এ বার প্রার্থী দিয়েছে ১৭টি ওয়ার্ডে। কংগ্রেস নেতা সম্রাট তপাদারের অভিযোগ, ‘‘তৃণমূলী সন্ত্রাস ছিলই। এখন নতুন উপদ্রব হয়েছে ঘাস ফুলের দ্বিতীয় সংস্করণ জোড়া পাতা। ৩ নম্বর ওয়ার্ডে জোড়া পাতার প্রার্থীর লোকেরা আমাদের প্রার্থীর উপর হামলা চালাচ্ছে। হুমকি দিচ্ছে।’’ জোড়া পাতা চিহ্নে দাঁড়ানো নির্দল প্রার্থী সুধা ঘোষের স্বামী প্রদীপ ঘোষ এই ওয়ার্ডের বিদায়ী তৃণমূল কাউন্সিলর। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, ‘‘নির্দল বলে আমার স্ত্রীকেই হুমকি আর হামলার ঝড় সামলাতে হচ্ছে। উনি মিথ্যা অভিযোগ করছেন।’’

বিদায়ী পুর-চেয়ারম্যান উত্তম দাস দাঁড়িয়েছেন ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে সিপিএম প্রার্থী কিছু দিন আগেই উত্তমবাবুর লোকেদের হাতে আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন। তা অস্বীকার করে উত্তমবাবু বলেন, ‘‘ব্যারাকপুরে কোনও সন্ত্রাস নেই। তা হলে কোনও দলই প্রার্থী দিতে পারত না।’’ পাশাপাশি তাঁর কথায়, ‘‘জোড়া পাতা চিহ্নে যাঁরা তৃণমূলকে বাঁচানোর কথা বলছেন তাঁরা স্বার্থান্বেষী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে দল থেকে বেরিয়ে গোঁজ প্রার্থী দেওয়ার আগে ওঁদের ভাবা উচিত ছিল দল সবার উপরে। তবে আমরা কাউকে বাধা দিইনি। পাঁচ বছরের কাজের নিরিখেই মানুষ আমাদের আবার সুযোগ দেবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন