সিপিএমের রক্তক্ষরণ অব্যাহত

বিধানসভা, লোকসভা বা লোকসভার উপ নির্বাচনের মতো এ বার পুরভোটেও সিপিএম তথা বামেদের রক্তক্ষরণ অব্যাহত বনগাঁয়। গোবরডাঙাতে গত পুরভোটের থেকে বামেরা খারাপ ফল করলেও লোকসভার উপ নির্বাচনের ফলের বিচারে দু’টি আসন তারা বেশি পেয়েছে। অশোকনগর-কল্যাণগড়ের পুরভোটে অবশ্য সিপিএম তুলনায় ভাল ফল করেছে। যদিও তা খুব আশা জাগানোর মতো নয়। সামনেই বিধাসভার ভোট। তার আগে ওই ফলাফল সিপিএমকে কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে রাখবে বলেই মনে করছেন জেলা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষ।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৫ ০০:২৫
Share:

বিধানসভা, লোকসভা বা লোকসভার উপ নির্বাচনের মতো এ বার পুরভোটেও সিপিএম তথা বামেদের রক্তক্ষরণ অব্যাহত বনগাঁয়। গোবরডাঙাতে গত পুরভোটের থেকে বামেরা খারাপ ফল করলেও লোকসভার উপ নির্বাচনের ফলের বিচারে দু’টি আসন তারা বেশি পেয়েছে। অশোকনগর-কল্যাণগড়ের পুরভোটে অবশ্য সিপিএম তুলনায় ভাল ফল করেছে। যদিও তা খুব আশা জাগানোর মতো নয়। সামনেই বিধাসভার ভোট। তার আগে ওই ফলাফল সিপিএমকে কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে রাখবে বলেই মনে করছেন জেলা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষ।

Advertisement

বনগাঁ শহরে এক সময়ে সিপিএম যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। কিন্তু গত বিধানসভা ভোটের পর থেকেই তারা ছন্নছাড়া। পুরসভায় ব্যর্থতার কারণ কী? বনগাঁর প্রাক্তন বিধায়ক তথা দলের বনগাঁ-বাগদা জোনাল কমিটির সম্পাদক পঙ্কজ ঘোষ বলেন, ‘‘ভোটটা তো আগেই হয়ে গিয়েছিল। যে ভাবে গুন্ডামো করে বুথ দখল ও ছাপ্পা ভোট দেওয়া হয়েছে, তাতে এই ফল প্রত্যাশিতই ছিল।’’ কিন্তু শুধুই কি তৃণমূলের সন্ত্রাস? নিজেদের কোনও ব্যর্থতা নেই? পঙ্কজবাবু বলেন, ‘‘তৃণমূলের গুন্ডামি প্রতিরোধ করবার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা ছিল।’’

পঙ্কজবাবু যাই বলুন, দলের নিচু তলার কর্মী-সমর্থকেরা মনে করছেন, ভোটের এ হেন ফলাফলের ক্ষেত্রে নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতার দিকটিও উপেক্ষা করা যায় না। শাসক দল সন্ত্রাস করেছে, বুথ দখল করে ছাপ্পা দিয়েছে, টাকা ছড়িয়েছে, ভয় দেখিয়েছে— কত রকমের অভিযোগ এখন বাম কর্মীদের মুখে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় নেমে সে সবের প্রতিরোধ-প্রতিবাদের নামগন্ধ নেই।

Advertisement

“এখানে আমার জয়ের কারণ জনসংযোগ আর প্রতিটি বাড়ির সঙ্গে সুসম্পর্ক।
আমার ওয়ার্ডে ছাপ্পা-সন্ত্রাস হওয়া সত্ত্বেও সে কারণে আমি জয়ী হতে পেরেছি।”
—মানবেন্দ্র কর্মকার (৫ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী সিপিএম প্রার্থী)

দলেরই অনেকে এখন জানাচ্ছেন, গত পাঁচ বছরে পুরসভায় ১০টি আসন থাকা সত্ত্বেও পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে সে ভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে বামেরা। সিপিএম কাউন্সিলরদের মধ্যে কাউকে কাউকে প্রকাশ্য মঞ্চে তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের দরাজ গলায় প্রশংসা করতে দেখা গিয়েছে। বিধানসভার ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের দক্ষতার অভাব ছিল বলেও সমর্থকদের একাংশ মনে করছেন। যুব সমাজকে পার্টি সদস্য করে তাদের সামনের সারিতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রেও ব্যর্থতা থেকে গিয়েছে। একের পর এক নির্বাচনে ব্যর্থতার পরেও নেতৃত্বের মুখ বদল হয়নি। সিপিএমের সদ্য প্রাক্তন এক কাউন্সিলরের কথায়, ‘‘যুদ্ধে নামার আগে কর্মী-সমর্থকদের যে ভাবে চাঙ্গা করা উচিত ছিল, নেতারা তা পারেননি।’’ বহু দিন বাদে শহরে নির্বাচনের আগে বামেদের দু’টি মিছিল দেখা গিয়েছে। কিন্তু ব্যর্থতা ঢাকতে তা অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে বলেই কর্মীদের একাংশ মনে করছেন। পাঁচ বছর ধরে পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলন নেই, অথচ ভোটের মুখে পুরসভার দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারের কথা বলা হয়েছে। মানুষ তা বিশ্বাস করতে পারেননি। পাশাপাশি নেতা-কর্মীদের মধ্যে জনসংযোগের অভাবও রয়েছে। ব্যক্তি স্বার্থে বহু কর্মী শাসক শিবিরে নাম লেখানোর ফলেও সংগঠন দুর্বল হয়েছে। এক সিপিএম কর্মীর কথায়, ‘‘শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেই নিজেদের ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যায় না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির দায়িত্বও নিতে হবে।’’ বনগাঁয় সভা করতে এসে সিপিএম নেতা গৌতম দেব দলীয় নেতাদের উদ্দেশে প্রকাশ্য সভায় মন্তব্য করেছিলেন,‘‘আপনারা পার্টিটাকে বৃদ্ধাশ্রমে পরিণত করতে চাইছেন নাকি!’’ বাস্তবিকই দলে নতুন মুখের দেখা সে ভাবে বনগাঁ শহরে দেখা যায় না। প্রার্থীদের ক্ষেত্রে নতুন মুখ কিছু আনা হলেও তাঁদের মাটি কামড়ে পড়ে থেকে ভোটের আগে জনসংযোগের চেষ্টা দেখা যায়নি। প্রার্থী হিসাবে নাম ঘোষণার পরেই অনেকে হাতেকলমে রাজনীতির ময়দানে গা ঘামিয়েছেন।

নিবিড় জনসংযোগ থাকলে ফল যে পাওয়া যায়, তার প্রমাণ ৫ নম্বর ওয়ার্ড। এখানে জয়ী হয়েছেন সিপিএম প্রার্থী মানবেন্দ্র কর্মকার। ভরাডুবির মধ্যেও তিনি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দেলের জেরে মানবেন্দ্রবাবু জয়ী হয়েছেন এমন কথা অনেক পার্টি কর্মীর মুখে শোনা যাচ্ছে বটে। তবে এটা বলে মানবেন্দ্রবাবুর সাফল্যকে অস্বীকার করা যাবে না, এমন মনে করেন দলের অনেক নেতা-কর্মীই। কয়েক জন সিপিএম কর্মী-সমর্থককে বলতে শোনা গেল, ‘‘আমাদের উচিত মানবেন্দ্রবাবুকে অনুসরণ করা।’’

লোকসভার উপ নির্বাচনে এগিয়ে থাকা পাঁচটি ওয়ার্ডেও সিপিএমের ভরাডুবি হয়েছে। হেরে গিয়েছেন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএমের দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর তাপস মুখোপাধ্যায়। তিনিও সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেছেন। অনেককেই প্রশ্ন তুলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘এত বছর কাউন্সিলর থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি নিজস্ব রক্ষাকবচ তৈরি করতে পারলেন না, যা দিয়ে সন্ত্রাসের প্রতিরোধ করা যেত?’’ ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থী হেরে গেলেও ভোটের দিন ওই ওয়ার্ডে বহিরাগতেরা দাঁত ফোটাতে পারেনি। কারণ ওই ওয়ার্ডে সিপিএমের সাংগঠনিক শক্তি এখনও রয়েছে।

তুলনায় সিপিএমের ভাল ফল হয়েছে অশোকনগর-কল্যাণগড়ে। গত পুরভোটে তারা পেয়েছিল দু’টি ওয়ার্ড। এ বার তারা পেয়েছে ৫টি আসন। অতীতে এখানে সিপিমের অন্দরের গোষ্ঠী কোন্দল ভয়াবহ আকার নিয়েছিল। এখন অবশ্য তা নেই। দু’টি গোষ্ঠীর নেতা-নেত্রীকে এ বার দল প্রার্থী করেছিল।

প্রাক্তন বিধায়ক সত্যসেবী কর পরাজিত হলেও কেউ বলতে পারবেন না তাঁর জনসংযোগ নেই। জয়ী হয়েছেন আর এক প্রাক্তন বিধায়ক ও প্রাক্তন পুরপ্রধান শর্মিষ্ঠা দত্ত। পাঁচ বছর ধরে এখানে সিপিএম তথা বামেরা নিয়মিত ভাবে মিটিং-মিছিল-সভা করেন। পুরসভার বিরুদ্ধে মাইক ধরেন। জনসংযোগ বাড়ানোর চেষ্টা নিয়মিত চেষ্টা লক্ষ্য করা গিয়েছে। যদিও ১২ নম্বর ওয়ার্ডে বাম ঐক্যে ফাটল ছিল। এখানে সিপিআই প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়ান সিপিএম পার্টি সদস্য তথা সত্যসেবীবাবুর ঘনিষ্ঠ তাপস পাল। হেরেছেন তিনি। সিপিএম নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, ঐক্য থাকলে ওই ওয়ার্ডটিও আসত।

পুরভোটের ফল নিয়ে সত্যসেবীবাবু বলেন, ‘‘লোকসভার তুলনায় আমাদের ফল একটু ভাল হয়েছে, তবে আশানুরূপ হয়নি। আমরা দ্রুত কারণ খতিয়ে দেখব।’’ এখানে পুরভোটের পরে সিপিএমের পক্ষ থেকে কোনও ওয়ার্ডেই ফের নির্বাচনের দাবি করা হয়নি। মোটামুটি শান্তিতেই ভোট পর্ব মিটেছে। সরাসরি সিপিএমের টিকিটে কাউকে দাঁড় না করিয়ে স্বচ্ছ্ব ভাবমূর্তির এবং রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন এমন ব্যক্তিকে নির্দল হিসাবে দাঁড় করিয়ে বামেদের সমর্থন দেওয়ার হিসেব এখানে কাজে এসেছে।

গোবরডাঙা পুরসভায় এ বার বামেরা তিনটি আসন পেয়েছে। তার মধ্যে একটি সিপিএম একটি বাম সমর্থিত নির্দল ও একটি সিপিআই। লোকসভার উপ নির্বাচনে ও লোকসভার নির্বাচনে এখানে সিপিএম বা বামেরা একটি মাত্র, ৯ নম্বর ওয়ার্ডে এগিয়ে ছিল। সেখানে অবশ্য এ বার সিপিএম হেরেছে। গত ভোটের ফলাফল ধরে রাখতে সিপিএম নেতৃত্ব আশাবাদী ছিলেন। সে বার তাঁরা পেয়েছিলেন ৫টি ওয়ার্ড। সিপিএম নেতা শঙ্কর নন্দী বলেন, ‘‘আরও ভাল ফল আশা করেছিলাম। কিন্তু সাংগঠনিক দুর্বলতা ও তৃণমূলের ভোট লুঠের জন্য ফল ভাল হয়নি।’’

সিপিএমের অভিযোগ প্রসঙ্গে জেলা তৃণমূল সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘চোরের মায়ের বড় গলা। ওরা চৌত্রিশ বছর ধরে ভোটকে প্রহসনে পরিণত করেছিল। আমরা সন্ত্রাস করলে অশোকনগরে ৫টি, বনগাঁয় ৩টি, গোবরডাঙায় ৩টি ওয়ার্ড বিরোধীদের পেতে হত না!’’ তাঁর দাবি, এ থেকেই বোঝা যায়, ভোট হয়েছে স্বচ্ছ্ব, শান্তিপূর্ণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন