উন্নতমানের সংগ্রহশালা চান স্থানীয় মানুষ

এক সময়ে হাড়োয়ায় ছিল সুন্দরবনের গরান, সুন্দরী, হরকোচ, গেঁওয়া, হেতাল গাছের ঝোপ। মাঝে মধ্যেই যার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসত বাঘ। সন্ধ্যার আগে জল খেতে আসত হরিণের দল। মুঘল আমলে বা ব্রিটিশ রাজের সময়ে হাড়োয়ার বালান্দা পরগনা ছিল সুন্দরবন এলাকার মধ্যে। মগ জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য ছিল আতঙ্কের কারণ। পানীয় জল ছিল অতি মাত্রায় নোনা। যে কারণে এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছিল। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় বাদাবন পরিষ্কার করে হাড়োয়ায় থাকতে শুরু করেন। পরবর্তিতে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও আসেন এখানে।

Advertisement

নির্মল বসু

হাড়োয়া শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৫ ০১:২৩
Share:

এই দশায় দাঁড়িয়ে আছে লাল মসজিদ।

এক সময়ে হাড়োয়ায় ছিল সুন্দরবনের গরান, সুন্দরী, হরকোচ, গেঁওয়া, হেতাল গাছের ঝোপ। মাঝে মধ্যেই যার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসত বাঘ। সন্ধ্যার আগে জল খেতে আসত হরিণের দল। মুঘল আমলে বা ব্রিটিশ রাজের সময়ে হাড়োয়ার বালান্দা পরগনা ছিল সুন্দরবন এলাকার মধ্যে। মগ জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য ছিল আতঙ্কের কারণ। পানীয় জল ছিল অতি মাত্রায় নোনা। যে কারণে এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছিল। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় বাদাবন পরিষ্কার করে হাড়োয়ায় থাকতে শুরু করেন। পরবর্তিতে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও আসেন এখানে।

Advertisement

অবিভক্ত ২৪ পরগনার হাড়োয়ার বালান্দা পরগনাটি ১৬৮৬ সালে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ইংরেজদের কাছ থেকে কিনে নেন। এরপরে বদলে যেতে থাকে হাড়োয়ার প্রাচীন চেহারা। বর্তমানে বিদ্যাধরী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে হাড়োয়া শহরতলি। নদীর এক পারে হাট-বাজার, থানা, হাসপাতাল, বিডিও, পঞ্চায়েত সমিতির অফিস। এ ছাড়াও আছে বালান্দা প্রত্ন সংগ্রহশালা। তবে নদীর অন্য পাড়ে, নজরনগর-শঙ্করপুর এখনও প্রত্যন্ত গ্রামের চেহারায় থেকে গিয়েছে। তবে মোটের উপরে এখন অনেক বদলেছে হাড়োয়ার চেহারা। বিদ্যাধরীর উপরে সেতু হয়েছে। বড় বড় বাড়ির পাশাপাশি রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুন্দর দোকানপাট হওয়ায় হাড়োয়া এখন বেশ জমজমাট।

হাড়োয়ার মাটির তলা থেকে উঠে আসা বহু প্রাচীন প্রত্নসামগ্রী, মন্দির, মসজিদ, মঠের ধ্বংসাবশেষ দেখে এবং প্রাচীন পুঁথি, দলিল ঘেঁটে যে সব তথ্য উঠে আসে, তাতে এটা স্পষ্ট যে এক সময়ে বালান্দা অঞ্চলে নগর ও বন্দর গড়ে উঠেছিল। সুন্দরবন থেকে নৌকা, বজরা ভর্তি করে গোলপাতা, মধু, ধান আসত হাড়োয়ার হাটে। সেখানে কেনা-বেচার পরে নদীপথে ওই মালপত্র চলে যেত কলকাতা- সহ দেশের বিভিন্ন বাজারে। কাছেই দেগঙ্গা ব্লকের বেড়াচাঁপার চন্দকেতু গড়। পুকুর, পাতকুয়ো খুঁড়তে গিয়ে বা বাড়ির ভিত কাটতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই প্রত্নবস্তু বেরিয়ে পড়ে। অনেকে তা নিজের বাড়িতে রেখে দিয়েছেন। অনেকে বিক্রি করে দিয়েছেন বহু টাকার বিনিময়ে। কিছু জিনিস ঠাঁই পেয়েছে সংগ্রহশালায়।

Advertisement

যত দূর জানা যায়, হাড়োয়া ও সন্নিহিত অঞ্চলে মাটির নীচে প্রত্নবস্তুর সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে পঞ্চাশের দশকে লিখিত ভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন হাড়োয়ার বাসিন্দা তথা সমাজসেবী মহম্মদ আবদুল জব্বার। বিষয়টি নিয়ে দিল্লিতে আলোচনার পরে ১৯৫৯ সালে চন্দ্রকেতু গড়ে কিছুটা খনন হয়।

সমাজসেবী জব্বারের মেয়ে, স্থানীয় স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা জাহানারা রহমান বলেন, ‘‘বাবার একটাই নেশা ছিল, হাড়োয়ার ইতিহাস মানুষের সামনে তুলে ধরা। সে জন্য তিনি দিনরাত এক করে মাটির তলার সম্পদ সংগ্রহ করে প্রথমে মেলায় ঘুরে প্রদর্শনী করতেন। ১৯৬৫ সালে বিদ্যাধরী নদীর পাশে বাড়িতে হাড়োয়া এবং বেড়াচাঁপা থেকে পাওয়া প্রত্নসামগ্রী নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন বালান্দা প্রত্ন সংগ্রহশালা। জব্বারের পরিবারের দাবি, ১৯৮৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে মেয়ে-জামাই সংগ্রশালার দেখভাল করছেন। তাঁরা চান দেশ-বিদেশের মানুষ যাতে হাড়োয়ার প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারেন, সে জন্য সরকারের পক্ষে হাড়োয়ায় আধুনিক একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হোক। যেখানে ছাত্রছাত্রীরা গবেষণার কাজও করতে পারবেন।


বালান্দা প্রত্ন সংগ্রহশালা ঘুরে দেখছে ছাত্রীরা।

হাড়োয়ার পাশ্ববর্তী দেগঙ্গার চন্দ্রকেতু গড়ে ১৯০৬ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে সরকারি এবং বেসরকারি ভাবে খননের ফলে প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শন প্রমাণ করছে যে, সিন্ধু সভ্যতার আমল থেকে বাংলার পাল রাজাদের আমল পর্যন্ত কয়েক হাজার বছর ধরে চন্দ্রকেতুগড় এবং সংলগ্ন হাড়োয়া অঞ্চল ছিল সভ্যতার পীঠস্থান।

এক সময়ে রীতিমতো সমৃদ্ধ জনপদ হিসাবে গড়ে উঠেছিল হাড়োয়া। এখান থেকে উত্তর দিকে মাত্র ছ’মাইল দূরে চন্দ্রকেতু গড়। এক সময়ে শুঙ্গ বংশের সম্রাটদের দাপট ছিল সেখানে। ব্যবসা-বাণিজ্য, সংস্কৃতি এবং সভ্যতার বিষয়ে চন্দ্রকেতু গড়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে। চন্দ্রকেতু গড়ে মাটির নীচ থেকে পাওয়া গিয়েছে সে যুগের প্রচুর শিল্প নিদর্শন। যার অনেকটাই বহু হাত ঘুরে অনেক টাকার বিনিময়ে বিদেশে চালাও হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছুটা হাড়োয়া এবং বেড়াচাঁপায় সংগ্রহশালায় রাখা আছে। দেশ-বিদেশের মানুষ যা দেখতে এখনও এখানে আসেন।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত, নগেন্দ্রনাথ বসু-সহ কয়েক জন চন্দ্রকেতুগড়-সহ হাড়োয়ায় অনুসন্ধান চালিয়ে অনেক প্রত্ননিদর্শন ও তথ্য খুঁজে বের করেন। হাড়োয়ায় উল্লেখযোগ্য স্থানের মধ্যে আছে পীর গোরাচাঁদের মাজার। কথিত আছে, প্রায় সাতশো বছর আগে হাড়োয়ায় এসেছিলেন পীর গোরাচাঁদ। প্রতি বছর ১২ ফাল্গুন শুরু হয় গোরাচাঁদের মাজার চত্বরে ধর্মীয় অনুষ্ঠান। সেই উপলক্ষে এক মাস ধরে মেলা চলে এখনও। দেশ-বিদেশ থেকে বহু মানুষ আসেন এখানে। খাস বালান্দা গ্রামে লাল মসজিদের প্রায় ৪০ ফুট উচুঁ ভগ্নস্তূপ আজও কোনও মতে টিঁকে রয়েছে। তার ভাঙা দেওয়ালের গায়েও অপূর্ব সুন্দর টেরাকোটার কাজ দর্শকদের মুগ্ধ করে। ওই এলাকায় বিভিন্ন সময়ে মাটির নীচ থেকে মুঘল আমলের তাম্রমুদ্রা উদ্ধার হয়। বালান্দা এবং চন্দ্রকেতু গড় এলাকায় বিভিন্ন সময়ে মাটির তলা থেকে উদ্ধার হয়েছে পোড়ামাটির বুদ্ধদেব, দ্বারপাল, জাতক কাহিনীর ফলকগুলি, ভাঙড়ে প্রাপ্ত পাথরের মঞ্জুশ্রী মূর্তি এবং মৃৎ নিদর্শনগুলি প্রমাণ করে, এই এলাকায় কয়েক হাজার বছর আগে মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ ও গুপ্ত যুগের জনবসতির কথা। হাড়োয়ার পিলখানায় হাতিশালা সম্পর্কে ইতিহাসে নানা তথ্য পাওয়া যা। হাতিশালটি রাজা চন্দ্রকেতুর আমলে তৈরি বলে দাবি কারও কারও। আবার সম্রাট আকবরের আমলে প্রতাপাদিত্য রায়ের বিরুদ্ধে মানসিংহের অভিযানের সময়ে এখানে হাতি রাখা হয়েছিল বলেও অনেকে দাবি করেন। পিলখালা গ্রামে মাটির তলায় আছে বৌদ্ধ মঠের ধ্বংসস্তূপ। সেখানে মাটির তলা থেকে পোড়া ইটের পদ্ম, জাফরি-সহ বিভিন্ন প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার হয়েছে। ওই ধ্বংসস্তূপ খননের জন্য স্থানীয়দের পক্ষ থেকে বহু বার সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা তথা বালান্দা প্রত্ন সংগ্রহশালার সম্পাদক আজিজুর রহমান বলেন, ‘‘হাড়োয়ার উত্তরে পিয়ারা দিঘি খননের সময়ে পাথরের বেদি, দক্ষিণে কুচপুকুরে কালো পাথরের ভগ্ন মূর্তি, পূর্বে মাজেরহাটি গ্রামে পুকুর খননের সময়ে প্রাপ্ত মিশ্র ধাতুর গণেশ মূর্তি, বাসাবাটি গ্রামে পুকুর খননের সময়ে উমা-মহেশ্বরের মূর্তি উদ্ধার হয়। আরও বহু নিদর্শন সংগ্রহ করে রাখা আছে।’’ স্থানীয় মানুষের দাবি, সরকারের উচিত সঠিক ভাবে খনন কাজ চালিয়ে এখানকার প্রাচীন ইতিহাসকে আরও ভাল ভাবে খুঁজে বের করা।

হাড়োয়ার বিধায়ক জুলফিকার আলি মোল্লা বলেন, ‘‘জব্বার সাহেব-সহ কেউ কেউ যে ভাবে হাড়োয়ার মাটির তলার সম্পদের বিষয়ে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে খননের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, আমিও তেমনটাই চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইতিহাসের টানে দেশ-বিদেশের বহু মানুষ এখানে আসেন। প্রত্নসামগ্রী নিয়ে যাতে বড় সংগ্রহশালা গড়া যায়, তার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনটা হলে পর্যটকদের আনাগোনা আরও বাড়বে। তা হলে আখেরে হাড়োয়ার মানুষই নানা ভাবে উপকৃত হবেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন