কাঁধে সংসারের বোঝা, এক হাতেই ভ্যান

অভাবে বুড়িয়ে যাওয়া চেহারার মানুষটার কাঁধের কিছুটা নীচ থেকে ডান হাতটাই নেই| তাতে কী? ব্রেকটাকে একটু শক্ত করে, প্রয়োজন মতো ডান পা তুলে ব্রেক কষেই আঠারো বছর আঁকড়ে রেখেছেন ভ্যানরিকশা।

Advertisement

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৮ ০২:৪৭
Share:

লড়াই: বাঁ পায়ে হ্যান্ডেল, ডান পায়ে ব্রেক। এমনি করেই ভ্যান চালান দেবু মান্না। আমতলা রোডে। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল

বাঁ হাত আর ডান বুক, এই দুইয়ের ভরসায় কখনও কুড়ি কিলোমিটার পথও পেরিয়ে যান। ক্লান্তি নামলেও থামা নেই। ঘরে যে তাঁর অপেক্ষায় চেয়ে রয়েছে আরও তিন জোড়া চোখ!

Advertisement

তাই শীত-বর্ষা-গ্রীষ্ম, একই ভাবে ভ্যানরিকশা টেনে যান বছর পঁয়তাল্লিশের দেবু মান্না। অভাবে বুড়িয়ে যাওয়া চেহারার মানুষটার কাঁধের কিছুটা নীচ থেকে ডান হাতটাই নেই| তাতে কী? ব্রেকটাকে একটু শক্ত করে, প্রয়োজন মতো ডান পা তুলে ব্রেক কষেই আঠারো বছর আঁকড়ে রেখেছেন ভ্যানরিকশা। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বিষ্ণুপুর ১ নম্বর ব্লকের কেওড়াডাঙার বাসিন্দা দেবু, কুড়ি বছর আগে এক দুর্ঘটনায় খুইয়েছিলেন ডান হাত। গুল কারখানায় কাজ করতেন। রাত জেগে কাজ করতে গিয়ে বোধ হয় চোখ জুড়িয়ে এসেছিল। তাই হাত ঢুকে গিয়েছিল যন্ত্রে। চেটো পর্যন্ত থেঁতলে গুঁড়িয়ে যাওয়া অংশটা প্রথমে বাদ দেন চিকিৎসকেরা। পরে গ্যাংগ্রিন হয়ে যাওয়ায় পুরো হাত বাদ দিতে হয়।

‘‘হাসপাতালে শুয়ে যে দিন বুঝলাম হাতটা নেই, কষ্ট হয়েছিল খুব। সেই শুরু নতুন লড়াইয়ের। একটু সুস্থ হতেই লোকের ভ্যান চেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দু’বছর ধরে এক হাতে ভ্যান চালানোর অভ্যাস করছিলাম। তার পরে রাস্তায় নামি।’’ — এক নাগাড়ে বললেন দেবু। সমস্যা হয় গরমে। সূর্য যতই চড়া হোক, বিশ্রাম নেই। ‘‘আনাজ, ইমারতি দ্রব্য, লোহার জিনিস বা মালপত্র— কিছুতেই না নেই দেবুর,’’ বলছিলেন আমতলারই এক ব্যবসায়ী। যে দিন মাল পৌঁছনোর বরাত মেলে না, সে দিন যাত্রীরাই ওঁর ভরসা। নিত্যযাত্রীরাও চিনে নিয়েছেন দেবুকে। মোহন চৌধুরী নামে এক যাত্রী বলেন, ‘‘এক হাতে ভ্যান চালান। তাই প্রথমে ভয় করত। এখন বরং ওঁর ভ্যানে না উঠলে মন খারাপ লাগে। এত অসুবিধা সত্ত্বেও যোগ্যতা দেখিয়ে রোজগার করেন, এটাই শিক্ষণীয়।’’ আমতলার দোকান থেকে ইমারতি জিনিস ভ্যানরিকশায় তোলার ফাঁকে দেবু জানালে, টানা বৃষ্টি হলে রোজগার বন্ধ। তখন কোনও রকমে এক বেলা খেয়ে দিন কাটে।

Advertisement

সরকারি সুবিধা পাননি? বাড়ির পাশেই কেওড়াডাঙা গ্রাম পঞ্চায়েত। দেবুর জবাব, ‘‘অনেক বার গিয়েছি। জব কার্ডের জন্য, মায়ের বিধবা ভাতার
জন্য, এমনকী বাড়ি করতে সরকার যে টাকা দেয়, তা-ও চেয়েছি। কিছুই পাইনি। বিপিএলের রেশন কার্ডটুকু আছে, এই যা। মাটির বাড়ি ভেঙে পড়েছিল। বাধ্য হয়ে চড়া সুদে টাকা নিয়ে একটা ঘর পাকা করেছি। মাসে মাসে সে টাকাও তো গুনতে হয়।’’

কেওড়াডাঙা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান পবিত্র ঘোষ বলছেন, ‘‘দেবুকে চিনি। উনি যে কিছু পান না, সেটা আমাদের দোষ নয়। ২০০৭-এর সমীক্ষা অনুযায়ী হাউজ হোল্ড বিপিএল তালিকাভুক্ত নয় দেবু মান্নার পরিবার। সমীক্ষায় ভুল ছিল। নতুন করে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার তালিকা তৈরি হচ্ছে। জব কার্ডের তালিকাতেও নাম তোলার সমীক্ষা হচ্ছে। ভুল শুধরে নেওয়া হবে।’’ বিষ্ণুপুর এক নম্বর ব্লকের বিডিও সুব্রত পালিত বলেন, ‘‘এমন হওয়ার কথা নয়। সমীক্ষায় ভুল হয়ে থাকলে কম্পিউটারে তো ওঁর কোনও তথ্য নেই। সরকারি সুবিধা পেতে নাম নথিভুক্ত করা জরুরি। ওঁরা সব কাগজপত্র নিয়ে সরাসরি আমার অফিসে এলে বিষয়টি দেখা হবে।’’

এমন অনেক আশ্বাস শুনেছেন দেবু। তাই বুক বাঁধেন না আর। বরং ভ্যান রিকশা টানতে বুকটা নমনীয় রাখেন। শত অভাবেও সাত বছরের মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়েছেন। শিক্ষাই যে অন্ধকারে আলো দিতে পারে, নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন