নিহত সঞ্জয় দাস।
প্রতিবাদ–আক্রমণ–হত্যা।
গাইঘাটা থেকে গড়বেতা। এ রাজ্যে শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকা উঠতি মস্তানদের হাতে প্রতিবাদীর নিগ্রহের ঘটনা নতুন নয়।
হালিশহরের সুভাষ নগর কদমতলার বাসিন্দা সঞ্জয় দাসও (৩৫) সেই ‘শহিদ’দের দলে নাম লেখালেন, যাঁদের নেশাগ্রস্ত সমাজবিরোধীদের বিরদ্ধে সরব হওয়ায় হত্যা করা হয়েছে।
কদমতলার সঞ্জয় নেহাতই ছাপোষা মানুষ। সিঙ্গুরের একটি হিমঘরে কাজ করতেন। বাবা ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতেন। মারা গিয়েছেন। মা এখন বাবার চাকরিটা করেন। একতলা পাকা বাড়ি। বাড়ির পাশেই জোড়া শিব মন্দির।
বিশ্বকর্মা পুজোর দিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন ছাদের জমা জল সারানো নিয়ে। সঞ্জয়ের মা বিমলাদেবী বলেন, ‘তখনই বাইরে হই-হল্লা, গালিগালাজ শুনে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল ছেলেটা। পাড়ার কিছু ছেলের সঙ্গে বাইরের ছেলেদের একটা দল শিব মন্দির আর পাশের ক্লাবে আড্ডা দিত। আড্ডার নামে নেশা আর কটূক্তি চলত। সঞ্জয় সেদিনও শিব মন্দিরের চাতালে বসা তিনজনকে বারণ করেছিল। ওরাই ওকে মেরে ফেলল।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, বিশ্বকর্মা পুজোর সন্ধ্যা থেকেই মাইকে চটুল গানের সঙ্গে নাচ ও কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি চলছিল শিব মন্দিরের পাশের ক্লাবে। রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ মন্দিরের চাতালে বসে মদ খাচ্ছিল সুবীর দত্ত, রতন শীল ও পিন্টু দাস নামে স্থানীয় তিন যুবক। নিজেদের মধ্যেই চিৎকার করে গালিগালাজ করছিল। এর মধ্যে সুবীর ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটে সিভিক পুলিশ হিসাবে কর্মরত। বাকি দু’জন কল সারানোর কাজ করে। সঞ্জয় তাদের সেখান থেকে চলে যেতে বললে, সুবীর নিজেকে পুলিশ বলে ক্ষমতা দেখায়। সঞ্জয়কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। রতন ও পিন্টু এলোপাথাড়ি মারতে থাকে তাঁকে। এক প্রতিবেশিনী কোনও রকমে সঞ্জয়কে উদ্ধার করে ঘরে নিয়ে যান। স্থানীয় এক চিকিৎসককে ডেকে পাঠানো হয়। তিনি প্রাথমিক চিকিৎসার পরেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সঞ্জয়কে প্রথমে কল্যাণী জেএনএম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও সেখান থেকে কলকাতায় আর জি কর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু, অবস্থার অবনতি হওয়ায় রবিবারই তাঁকে কলকাতার একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়। বিকালে সেখানেই মৃত্যু হয় সঞ্জয়ের। প্রতিবাদী যুবকের মৃত্যুর খবর পাড়ায় আসার পরেই এলাকায় উত্তেজনার পারা চড়তে থাকে। রাতে ওই শিব মন্দির-সংলগ্ন ক্লাব ঘরে ভাঙচুর করেন বাসিন্দাদের একাংশ। ভাঙচুরের চেষ্টা হয় অভিযুক্তদের বাড়িতেও।
বাসিন্দারা জানান, এক সময় সিপিএমের পার্টি অফিস ছিল এই ক্লাব ঘরটি। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর সিপিএম কর্মীদের হঠিয়ে ওই ঘর দখল করে নেয় তৃণমূল সমর্থকেরা। নতুন করে পার্টি অফিসের বদলে রাতারাতি ক্লাব ঘর হয়ে যায় সেটি। বিভিন্ন অনুদান ও জুলুম করে তোলা চাঁদার দৌলতে ক্লাব সদস্যদের ‘নেশার ভাঁড়ার’ হয়ে যায় ওই ঘরটি। রবিবার রাতে সঞ্জয়ের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর ওই ক্লাব ঘরের লাগোয়া একটি চায়ের দোকানও ভাঙচুর করা হয়। ক্লাব ও ওই দোকান থেকে অজস্র মদের বোতল, নেশার সামগ্রী বের করে এনে ভাঙচুর করে উত্তেজিত জনতা। শেষ পর্যন্ত পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি সামলায়।
সোমবারও সকাল থেকে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। একজন পুলিশ কর্মী এই ঘটনায় জড়িত। স্থানীয় বাসিন্দা অনিমা দাস বলেন, ‘বীজপুর থানার সিভিক পুলিশ বলে সকলকে ভয় দেখাত সুবীর। সকলের সামনে বসে নেশা করত। কেউ কিছু বলার সাহস পেত না। একমাত্র সঞ্জয়ই প্রতিবাদ করতে এগিয়ে গিয়েছিল। ওকে তাই মরতে হল।’
এলাকায় পুলিশ পিকেট রবিবার রাতেই বসেছিল। সোমবার ফের ওই ক্লাবে ভাঙচুরের চেষ্টা হলে ব্যারাকপুরের এডিসিপি শুভঙ্কর ভট্টাচার্য ও বীজপুরের ওসি বিশ্বজিৎ মণ্ডল ঘটনাস্থলে পৌঁছন। বাসিন্দাদের সঙ্গে বাগবিতন্ডা শুরু হয় পুলিশ কর্তাদের। বাসিন্দারা মূল তিন অভিযুক্তের সঙ্গে আরও তিন জনের নামে অভিযোগ দায়ের করেন। তাদের মধ্যে একজন ওই চা দোকানের মালিকের ছেলে স্বপন রাহা। অন্য দু’জন কুমারেশ পাল ও বিশ্বজিৎ পাল। ছ’জনকে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবিতে পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান বাসিন্দারা। শেষ পর্যন্ত এডিসিপি ২৪ ঘন্টার মধ্যে অভিযুক্তদের গ্রেফতারের বিষয়ে আশ্বস্ত করলে জনতা শান্ত হয়। সঞ্জয়ের দেহ ময়না তদন্তের পর দাহ করা হয়।
হালিশহর পুরসভার চেয়ারম্যান অংশুমান রায় বলেন, ‘ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে যে গণ্ডগোল হয়েছে, তার সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। তবে সঞ্জয়ের মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমরা ওর পরিবারের সঙ্গে আছি। হামলাকারীদের সঙ্গে তৃণমূলের কোনও যোগাযোগ নেই।’