কাতরাচ্ছেন যুবক, রোগ কমাতে গুনিন

দশ দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন দেগঙ্গার হরেকৃষ্ণ কোঙার কলোনির বাসিন্দা, মধ্য চল্লিশের অনুপ সর্দার। স্থানীয় বাজার থেকে ওষুধ এনে খাওয়ানোর পরেও জ্বর না কমায় মঙ্গলবার তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বিশ্বনাথপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৯ ০৩:২১
Share:

অসহায়: অসুস্থ অনুপ সর্দারের উপরে ঝাড়ফুঁক করছেন গুনিন। বুধবার, দেগঙ্গায়। ছবি: সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়

দু’-দু’টি সরকারি হাসপাতাল ফিরিয়ে দিয়েছে। হয়নি চিকিৎসা, কমেনি জ্বর। যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা রোগীর চিকিৎসায় শেষমেশ তাই শুরু হল গুনিনের ঝাড়ফুঁক। রোগীর হাত-পা ধরে রেখে নাকে-মুখে ধোঁয়া দিয়ে চলল ‘জিন তাড়ানো’র কাজ। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকলেন সেই যুবক। প্রত্যন্ত এলাকা নয়, কলকাতার কাছেই দেগঙ্গায় বুধবার ঘটেছে এই ঘটনা।

Advertisement

দশ দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন দেগঙ্গার হরেকৃষ্ণ কোঙার কলোনির বাসিন্দা, মধ্য চল্লিশের অনুপ সর্দার। স্থানীয় বাজার থেকে ওষুধ এনে খাওয়ানোর পরেও জ্বর না কমায় মঙ্গলবার তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বিশ্বনাথপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেই হাসপাতাল থেকে বারাসত জেলা হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় ওই আদিবাসী যুবককে। তাঁর ভাই দিলীপ সর্দার জানান, অবস্থা সঙ্কটজনক হওয়ায় অনুপকে আইসিইউ-এ রাখা হয়। বুধবার সকালে ওই হাসপাতাল তাঁকে রেফার করে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু টাকার অভাবে অনুপের পরিবার তাঁকে আর জি করে আনতে পারেনি।

পরিবার সূত্রের খবর, এর পরে বাড়ির একমাত্র রোজগেরে, দিনমজুর ওই যুবককে বুধবার সকাল ১০টায় বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। অনুপের স্ত্রী আঙুরবালা বলেন, ‘‘উনি দশ দিন ধরে কাজে না যাওয়ায় খাওয়া জুটছিল না। চেয়েচিন্তে ওষুধ কিনেছি। বারাসত হাসপাতাল রাখল না। আর কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই।’’ বাড়িতে ফেরার পরে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন অনুপ। তখন তাঁর পরিবার ও স্থানীয় কয়েক জনের উদ্যোগে দেগঙ্গা বাজার থেকে ডেকে আনা হয় এক গুনিনকে। এ দিন বেলা সাড়ে ১২টা থেকে দুপুর আড়াইটে পর্যন্ত চলতে থাকে সেই গুনিনের কেরামতি।

Advertisement

গঙ্গার ধারে আদিবাসী কলোনিতে পলিথিনে ঘেরা ছোট্ট এক কুঠুরিতে স্ত্রী ও ছোট ছোট তিন ছেলেকে নিয়ে থাকেন অনুপ। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মাটির মেঝেতে শুয়ে ছটফট করছেন তিনি। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। মুখ দিয়ে গোঙানির শব্দ বেরোচ্ছে। একটি টেবিল ফ্যান চলছে, তবু দরদর করে ঘামছেন ওই যুবক। দু’পাশে হাত-পা ধরে বসে ছেলেরা। তখনও পরানো রয়েছে হাসপাতালের ক্যাথিটার। স্থানীয় এক হাতুড়ে ডাক্তারকে ডেকে খোলা হয় সেটি।

বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ পোঁটলা নিয়ে মোটরবাইকে চেপে আগমন ঘটে গুনিনের। হাতে লেখা হিজিবিজি একটি কাগজ (যেটাকে তাবিজ বলছিলেন তিনি) বুকের উপরে চেপে ধরে চলে ‘নাকপোড়া।’ নাকের কাছে কাগজ পুড়িয়ে বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে গুনিন বলতে থাকেন, ‘‘তুই যেখানে ছিলিস, সেখানে যা, কেন গরিব মানুষের সংসার নষ্ট করছিস!’’

শ্বাসকষ্টে, যন্ত্রণায় তখন ছটফট করছেন অনুপ। তাঁর হাত-পা চেপে ধরে রাখা হয়। সর্বশক্তি দিয়ে সব কিছু ঠেলে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসেন অনুপ। বড় বড় চোখে চার দিকে তাকাতে থাকেন। গুনিন চিৎকার করে ওঠেন, ‘‘রাস্তা ছেড়ে দাও, রাস্তা ছেড়ে দাও। ও এ বার চলে যাবে।’’ তত ক্ষণে ভিড় জমে গিয়েছে ঘরের আশপাশে। ভয় পেয়ে সবাই সরে দাঁড়ালেন। ঝাড়ফুঁক, তেলপোড়া-জলপোড়া খাওয়ানো, ফের কাগজ পুড়িয়ে নাকে ধোঁয়া দেওয়া চলতেই থাকে। অনুপের দু’হাতে, গলায়, কোমরে তাবিজ পরানো হয়। পরে আবার আসতে হবে, জানিয়ে দেন গুনিন।

এ সব করে কি জ্বর বা ডেঙ্গি সারে? প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন গুনিন। দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘‘পৃথিবীতে দু’টো জিনিস আছে। চিকিৎসা আর অশুভ শক্তি। জিন ধরলে তাড়াতে হয়, সেই চেষ্টাই আমি করেছি।’’ কেন এ সব করছেন, প্রশ্ন করলে এলাকার মানুষও ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘‘চিকিৎসা করাতেও তো নিয়ে গিয়েছিলাম। অত বড় হাসপাতালের ডাক্তারেরা জবাব দেওয়ার পরেও মানুষটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করব না!’’

অনুপের আত্মীয় জয়ন্ত ভুঁইয়া বলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালে নাকি বিনা পয়সায় চিকিৎসা হয়! কিন্তু আমাদের মতো গরিব আদিবাসী চিকিৎসা পেল কোথায়? আমাদের স্বাস্থ্য বিমাও নেই। ডেঙ্গি হয়েছে কি না, সেই রিপোর্টও দেওয়া হল না। ওষুধ, ইঞ্জেকশনের এত দাম যে, না পেরে বাড়ি নিয়ে এসেছি।’’

এ বিষয়ে বারাসত হাসপাতালের সুপার সুব্রত মণ্ডল বলেন, ‘‘ওই রোগীর অবস্থা খারাপ ছিল। সে কথা জানানোর পরে বাড়ির লোকেরাই তাঁকে অন্যত্র নিয়ে যায়। কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার অসুবিধার কথা আমাদের জানানো হয়নি। প্রতিদিন অনেক গরিব রোগীকেই আমরা বিনা পয়সায় অ্যাম্বুল্যান্সে কলকাতায় পাঠাই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন