লাইনে পড়ে ছাত্রের নিথর দেহ, উপর দিয়ে ছুটল একের পর এক ট্রেন

ইয়ারফোন গোঁজা অবস্থায় রেললাইন পার হচ্ছিলেন তিনি। এক্সপ্রেস ট্রেনটা  এসে ধাক্কা মারতেই লাইনের উপরে ছিটকে পড়েন ওই কলেজছাত্র। তার পরেও ঘণ্টাখানেক লাইনের উপরেই পড়ে রইল নিথর দেহটি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৮ ০৩:৩৩
Share:

সোহম মিত্র

ইয়ারফোন গোঁজা অবস্থায় রেললাইন পার হচ্ছিলেন তিনি। এক্সপ্রেস ট্রেনটা এসে ধাক্কা মারতেই লাইনের উপরে ছিটকে পড়েন ওই কলেজছাত্র। তার পরেও ঘণ্টাখানেক লাইনের উপরেই পড়ে রইল নিথর দেহটি। উপর দিয়ে পার হয়ে গেল একের পর এক লোকাল ট্রেন।

Advertisement

মঙ্গলবার খড়দহ স্টেশনে এমনই দৃশ্যের সাক্ষী থাকলেন অসংখ্য নিত্যযাত্রী। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ প্রতিবাদ করলেও সোহম মিত্র (২০) নামে ওই তরুণের দেহ রেললাইন থেকে ওঠাতে সময় লেগে গেল প্রায় এক ঘণ্টা।

সোহম সোদপুরের সুখচর এলাকার একটি আবাসনে থাকতেন। মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তিনি পড়তেন রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন কলেজে। রসায়নের মেধাবী ছাত্রটি সদ্য তৃতীয় বর্ষে উন্নীত হয়েছিলেন। এ দিন কলেজেই যাচ্ছিলেন সোহম। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে হতবাক তাঁর বাবা-মা। শোকস্তব্ধ পড়শিরা।প্রত্যক্ষদর্শীদের থেকে জানা গিয়েছে, ট্রেন আসছে দেখে সোহমকে চিৎকার করে অনেকেই সাবধান করেছিলেন। কিন্তু ইয়ারফোন গোঁজা থাকায় তিনি শুনতে পাননি। এমনকি, লাইন পার হওয়ার সময়েও দেখেননি, ট্রেন আসছে কি না। কিন্তু তার পরে যা ঘটল, তাতে বিস্মিত রেলের যাত্রী থেকে স্থানীয় বাসিন্দা, প্রত্যেকেই। তাঁদের প্রশ্ন, যে লাইনে একটি মৃতদেহ পড়ে আছে, সেখান দিয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ করা হল না কেন? পুলিশই বা কেন দেরি করে পৌঁছল?

Advertisement

শিয়ালদহ রেলপুলিশের সুপার অশেষ বিশ্বাস বলেন, ‘‘পুলিশ ঠিক সময়েই দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল। কিন্তু ডোমেরা দেরি করে আসায় ওই কলেজছাত্রের দেহ লাইন থেকে তুলতে দেরি হয়। ডোমেরা শিয়ালদহ থেকে গিয়েছিলেন বলে তাঁদের পৌঁছতে দেরি হয়েছিল।’’

কী ঘটেছিল এ দিন?

তখন সকাল পৌনে ১১টা। আসানসোল-শিয়ালদহ ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস চার নম্বর লাইন দিয়ে খড়দহ পার হচ্ছিল। ট্রেনটির খড়দহে দাঁড়ানোর কথা ছিল না। সেই সময়ে প্ল্যাটফর্ম লাগোয়া লেভেল ক্রসিং ধরে লাইন পার হচ্ছিলেন সোহম। ট্রেন আসছে দেখে যাত্রীদের অনেকেই চিৎকার করে তাঁকে

সাবধান করতে চেষ্টা করেন। হর্ন দিয়েছিল ট্রেনটিও। না যাত্রীদের চিৎকার, না ট্রেনের হর্ন— সোহমের কানে যায়নি কিছুই।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ট্রেনের ধাক্কায় লাইনে ছিটকে পড়েন সোহম। ওই অবস্থায় তাঁকে মিটার দশেক ঠেলে নিয়ে যায় ট্রেনটি। তার পরে দেহটি লাইনের মাঝে পড়ে যায়। ট্রেনটি তার উপর দিয়েই চলে যায়। মাথার একটি অংশ তখনও লাইনেই ছিল। দেহ ঘিরে ভিড় জমে যায়।স্থানীয় বাসিন্দা রবি পাসোয়ান বলেন, ‘‘দুর্ঘটনার কিছু ক্ষণ পরেই ওই লাইনে একটি লোকাল ট্রেন আসে। সেটি ছেলেটির দেহের উপর দিয়েই চলে যায়।

অনেকেই ট্রেনটিকে হাত দেখিয়ে থামাতে চেষ্টা করেছিলেন।’’ স্থানীয় ব্যবসায়ী বিকাশ সরকার বলেন, ‘‘একটি দেহ পড়ে রইল লাইনে। পুলিশ এল এক ঘণ্টা পরে। চাইলে রেল তো ওই লাইন দিয়ে ট্রেন না চালালেও পারত।’’ সোহমের পকেটে তাঁর কলেজের পরিচয়পত্র ছিল। সেখান থেকেই কলেজের ফোন নম্বর মেলে।

কলেজ থেকে খবর দেওয়া হয় সোহমের বাবা শুভ্ররঞ্জন মিত্রের কাছে। তিনি গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডার্সে চাকরি করেন। ওই সময়ে অফিসেই ছিলেন। পড়শি সুপ্রিয় আইচকে তিনি খবর দেন। সুপ্রিয়বাবু সঙ্গে সঙ্গে খড়দহে পৌঁছন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের চোখের সামনেই একটার পর একটা ট্রেন চলে গেল ওর দেহের উপর দিয়ে। যে ছেলেটাকে খেলে বেড়াতে দেখেছি, তার এমন পরিণতি মানতে পারছি না।’’ সোহমের মা শর্মিষ্ঠাদেবী কাঁদার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছেন। কোনও কথাই বলছেন না তিনি।

এই মর্মান্তিক ঘটনার পরেও যে যাত্রীদের হুঁশ ফেরেনি, তার প্রমাণ মিলল এ দিন দুপুরেই। ইয়ারফোন লাগিয়ে দুর্ঘটনার জায়গা দিয়েই নির্দ্বিধায় লাইন পার হতে দেখা গেল অনেককেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন