‘নিশ্চিন্ত’ ভোটেও তৃণমূলের অস্বস্তি জিইয়ে রেখেছে যানজট

শাসক দলের সাফল্যের পারদ চড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে আর সিপিএমের ক্রমশ রক্তক্ষরণ। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক নির্বাচনে এটাই বনগাঁর রাজনীতির অতি পরিচিত ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বারের পুরভোটে তৃণমূল তাদের সাফল্যের চাকায় আরও গতি আনতে আসরে নেমে পড়েছে। ক্ষয়িষ্ণু সংগঠন নিয়ে বামেদের চেষ্টা ভাগ্যের চাকা উল্টো দিকে ঘোরানোর। বনগাঁ লোকসভার উপ নির্বাচনে জোর ধাক্কা খাওয়া বিজেপি মানুষের সমর্থনের ভিত্তি ফের ফিরিয়ে আনতে তৎপর। কংগ্রেসের চেষ্টা রয়েছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার। এক নজরে এটাই বনগাঁর পুরভোট।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৫ ০২:১৯
Share:

শেষবেলায় প্রচারে শতাব্দী রায়।

শাসক দলের সাফল্যের পারদ চড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে আর সিপিএমের ক্রমশ রক্তক্ষরণ। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক নির্বাচনে এটাই বনগাঁর রাজনীতির অতি পরিচিত ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বারের পুরভোটে তৃণমূল তাদের সাফল্যের চাকায় আরও গতি আনতে আসরে নেমে পড়েছে। ক্ষয়িষ্ণু সংগঠন নিয়ে বামেদের চেষ্টা ভাগ্যের চাকা উল্টো দিকে ঘোরানোর। বনগাঁ লোকসভার উপ নির্বাচনে জোর ধাক্কা খাওয়া বিজেপি মানুষের সমর্থনের ভিত্তি ফের ফিরিয়ে আনতে তৎপর। কংগ্রেসের চেষ্টা রয়েছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার। এক নজরে এটাই বনগাঁর পুরভোট।

Advertisement

রাজ্যে ক্ষমতায় পালাবদলের অনেক আগে থেকেই বনগাঁ তৃণমূলের খাসতালুকে পরিণত। ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে গোটা রাজ্যে তৃণমূলের ভরাডুবির মধ্যেও বনগাঁ মহকুমার তিনটি বিধানসভা আসনেই জয়ী হয়েছিল তারা। এখন পুরসভা, বিধানসভা বা লোকসভা সবই তাদের দখলে। স্বাভাবিক ভাবেই শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে পুরভোটের আসরে নেমেছে তারা। পাশাপাশি তাদের অনেকটাই এগিয়ে রেখেছে সদ্য সমাপ্ত বনগাঁ লোকসভার উপ নির্বাচনে দলের সাফল্য। পুর এলাকার ২২টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল প্রার্থী মমতা ঠাকুর এগিয়ে ছিলেন ১৭টি ওয়ার্ডেই। যে ওয়ার্ডগুলিতে সিপিএম প্রার্থী দেবেশ দাস এগিয়ে ছিলেন, সেগুলি হল— ৬, ৭, ৮, ১৯ ও ২০ নম্বর। যদিও ২০১০ সালের পুর নির্বাচনে সিপিএম পেয়েছিল ১০টি ওয়ার্ড।

পরিসংখ্যানে, শাসক দল অনেকটাই এগিয়ে থাকলেও সিপিএম নেতৃত্ব মনে করছে, মানুষ যদি ভোট দিতে পারেন তা হলে বামপন্থীরাও লড়াইয়ে থাকবে। বনগাঁ প্রাক্তন বিধায়ক সিপিএমের পঙ্কজ ঘোষের কথায়, ‘‘মানুষ যদি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিতে পারেন, তা হলে হারব বা জিতব কিনা বলতে পারব না, তবে বামপন্থীরা লড়াইয়ে থাকবে।’’

Advertisement

সন্ত্রাসের বিচ্ছিন্ন অভিযোগও তুলেছেন বামেরা। যার বেশির ভাগ ফ্লেক্স ছেঁড়া, ভয় দেখানোর মতো। তবে সে সব নিয়ে থানা-পুলিশ তেমন হয়নি। পঙ্কজবাবুর কথায়, ‘‘সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি হয়েছে শহর জুড়ে। ইচ্ছে থাকলেও আমাদের মিটিং-মিছিলে অনেকেই আসতে পারছেন না। ভোটের দিনও অনেকে দায়িত্ব নিতে চাইছেন না।’’ এ সবের মধ্যেও অবশ্য বহু দিন বাদে শহরের মানুষ বামেদের দু’টি বড় মিছিল দেখেছেন। যা দেখে পথ চলতি মানুষকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘অবশেষে তা হলে ঘুম ভাঙল!’’

তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য তাদের বিরুদ্ধে ওঠা সন্ত্রাসের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস বলেন, ‘‘ভোটের আগেই সিপিএম বুঝতে পেরেছে পরাজয় নিশ্চিত। তাই সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে এখন থেকেই কাঁদুনি গাইতে শুরু করেছে। কোনও অভিযোগ থাকলে পুলিশকে ওরা জানাক। আমাদের বলুক। আমরা দলীয় ভাবে ব্যবস্থা নেব।’’

১৩ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থীর মায়া ঘোষের নির্বাচনী কার্যলয়ে তাঁর প্রচারের ব্যানার ফ্লেক্স পোস্টার খুলে ছিঁড়ে দিয়ে ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী মৌসুমী চক্রবর্তীর ফ্লেক্স-ব্যানার লাগিয়ে কার্যালয় দখলের অভিযোগ উঠেছিল শাসক দলের বিরুদ্ধে। কিন্তু ওই খবর পেয়ে বিধায়ক বিশ্বজিৎবাবু ঘটনাস্থলে গিয়ে দলীয় ব্যানার-পোস্টার খুলে সিপিএমকে কার্যালয় ফিরিয়ে দিয়েছেন। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী বোর্ডের পুরপ্রধান জ্যোৎস্না আঢ্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। ওই ওয়ার্ডে প্রার্থী দিয়েছিল বিজেপি ও সিপিআই। পরবর্তী সময়ে অবশ্য তাঁরা মহকুমাশাসকের দফতরে গিয়ে ‘স্বেচ্ছায়’ মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। যদিও প্রচারে বামেরা ওই বিষয়টিকে শাসক দলের সন্ত্রাস হিসাবে তুলে ধরেছে। শহর তৃণমূল সভাপতি শঙ্কর আঢ্য অবশ্য জানান, ‘‘ওই দুই প্রার্থী ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ছিলেন না। তাঁরা ওয়ার্ডের উন্নয়ন দেখে ও পরাজয় নিশ্চিত বুঝে স্বেচ্ছায় প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করেন।’’

কিছু ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী নিয়ে দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে নির্দল প্রার্থী হিসাবে ভোটে তৃণমূল প্রার্থী সুফল হালদারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন বনগাঁ শহর তৃণমূলের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মনোতোষ নাথ। দল তাঁকে বহিষ্কার করেছে। মনোতোষবাবু তাঁর বিরুদ্ধে দুষ্কৃতী হামলার অভিযোগ এনেছেন।

লোকসভার উপ নির্বাচনে বিজেপি পুরসভার ১০টি ওয়ার্ডে দ্বিতীয় হয়েছে। তারা ২২টি ওয়ার্ডেই প্রার্থী দিয়েছিল। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী মনোনয়ন তুলে নিলেও ২১টি ওয়ার্ডে তারা লড়াই করছে। বিজেপি নেতা মধুসূদন মণ্ডলের অভিযোগ, ‘‘বিভিন্ন ওয়ার্ডে আমাদের প্রার্থীদের পতাকা, ফ্লেক্স ছিঁড়ে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ-প্রসাশনকে জানিয়েও কোনও সুরাহা হয়নি। মানুষ যদি ভোট দিতে পারেন, তা হলে অনেক হিসেব উল্টে যাবে।’’

কংগ্রেস ১৬টি ওয়ার্ডে প্রার্থী দিয়েছে। সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকট। গত পুরভোটে কংগ্রেস পেয়েছিল ৫টি আসন। ওই পাঁচ কাউন্সিলর দলত্যাগ করে পরে শাসক দলে যান। ফলে কংগ্রেস এখানে আরও দুর্বল হয়েছে। শহর কংগ্রেস সভাপতি কৃষ্ণপদ চন্দ বলেন, ‘‘আশা করছি গোটা তিনেক ওয়ার্ডে জয়ী হতে পারব।’’ প্রত্যাশা কম, কাজেই চাপও কম তাঁদের।

পুর বোর্ডের গত পাঁচ বছরের উন্নয়নকে হাতিয়ার করেই এ বার প্রচারে নেমেছে তৃণমূল। কিন্তু শহরের যানজট সমস্যা মেটানো যায়নি বলে শাসক দলের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু উন্নয়ন যে হয়েছে, তা সাধারণ নাগরিকেরাও স্বীকার করছেন। শ্মশানে বৈদ্যুতিক চুল্লি, স্বাস্থ্যদীপ, নতুন পুরভবন, অডিটোরিয়ামের মতো কিছু কাজ চোখে দেখাই যাচ্ছে। শহর সেজেছে আলোর মালায়। যদিও পুরসভার বিরোধী দলনেতা সিপিএমের সুনীল সরকার বলেন, ‘‘ওয়ার্ডের ভিতরে ভিতরে আলো, পানীয় জল, নিকাশি নিয়ে সমস্যা আছে। রাস্তাঘাটও খারাপ। কোন খাতে কত টাকা এসেছে, তারও কোনও হিসেব দেয়নি পুরবোর্ড।’’ বিদায়ী পুরপ্রধান জ্যোৎস্না আঢ্য অবশ্য জানান, ওরা নানা সময়ে উন্নয়নের কাজে বাধা দিয়েছে। এতই যদি অভিযোগ, তা হলে পাঁচ বছরে আমার কাছে একটাও স্মারকলিপি জমা দিলেন না কেন?’’

কিন্তু যানজটে নাকাল হওয়া মানুষ কিছুতেই এই সমস্যার কথা ভুলতে পারছেন না। প্রচারে বেরিয়েও এ প্রসঙ্গ উঠলে তৃণমূলকে অস্বস্তিতে পড়তে দেখা যাচ্ছে।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন