lockdown

অবসরেও ছুটি নেই অমল মাস্টারের

চাকরি থেকে অবসর নিয়েও বিশ্রাম নেননি মাস্টারমশাই। নিজের বাবার নামে রাখালচন্দ্র সেবাশ্রম তৈরি করে সেখানেই চলছে দুঃস্থ, অনাথ শিশুদের লালনপালন।

Advertisement

প্রসেনজিৎ সাহা

বাসন্তী শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৬:০৮
Share:

শিশুদের পড়াচ্ছেন অমল। নিজস্ব চিত্র

২০১৫ সালে স্কুল থেকে অবসর নিয়েছেন অমল পণ্ডিত। বাসন্তীর মহেশপুর যশোদা বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতা করতেন তিনি। চাকুরি জীবন থেকে অবসর নিলেও আজ পর্যন্ত ছুটি নেই তাঁর। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের বাপ-মা মরা ছেলেপুলেদের দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত তিনি।
চাকরি জীবনেই কাজটা শুরু করেছিলেন। চাকরি থেকে অবসর নিয়েও বিশ্রাম নেননি মাস্টারমশাই। নিজের বাবার নামে রাখালচন্দ্র সেবাশ্রম তৈরি করে সেখানেই চলছে দুঃস্থ, অনাথ শিশুদের লালনপালন। জনা তিরিশ ছাত্র নিয়ে চলছে এই সেবাশ্রম। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে অমল পণ্ডিতই এই সব শিশুদের অভিভাবক।
বিয়ে থা করেননি, পাছে এই সব শিশুদের দেখভালে কোনও অসুবিধা হয়। পিতৃপ্রতিম শিক্ষক সুধীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন সমাজসেবার শিক্ষা। পেয়েছিলেন দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উৎসাহ। সেই থেকেই শুরু হয়েছিল তাঁর সমাজসেবা।
১৯৯০ সালে বাসন্তীর ভরতগড় পঞ্চায়েতের মহেশপুরে পৈতৃক ভিটের উপরেই তৈরি হয় রাখালচন্দ্র সেবাশ্রম। একে একে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের দুঃস্থ ও আদিবাসী পরিবার থেকে শিশুরা আসতে শুরু করে অমল স্যারের কাছে। আশ্রমেই চলে শিক্ষাদান। পড়াশোনার পাশাপাশি গান বাজনা, ছবি আঁকা, খেলাধুলা সবেতেই নজর রাখেন স্যার। থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থাও আশ্রমেই।
প্রথমে দু’চারজনকে নিয়ে শুরু করলেও যত দিন গড়িয়েছে, ততই অমল স্যারের আশ্রমে বেড়েছে আবাসিকের সংখ্যা। নিজের বেতনের সমস্ত টাকাই এই আশ্রমের পিছনে খরচ করতে শুরু করেন তিনি। সে সময়ে অমল স্যারের পাশে দাঁড়ান গ্রামের বহু মানুষও। নিজেদের চাষের ধান, চাল কেউ বা আনাজ দিয়ে সাহায্য করতে শুরু করেন তাঁকে। সেই রীতি এখনও চলছে। এখনও বহু মানুষ নিজেদের সাধ্য মতো অমল স্যারের পাশে দাঁড়ান। কেউ কিছু দিয়ে তো কেউ নিজের কায়িক শ্রম দিয়ে এই আশ্রমকে এগিয়ে চলতে সাহায্য করছেন।
আশ্রমে থেকে পড়াশোনা করে অনেকেই জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কেউ স্কুল কলেজের শিক্ষক হয়েছেন তো কেউ ইঞ্জিনিয়ার। কেউ বা বড়মাপের কীর্তনিয়া হয়েছেন। আশ্রমের প্রাক্তনীরাও অনেকে দাঁড়িয়েছেন স্যারের পাশে।
বছর পাঁচেক আগে অবসরের পর কী ভাবে চলবে আশ্রম, ভেবেই আতঙ্কিত হয়েছিলেন শিক্ষক। কিন্তু গ্রামবাসী থেকে শুরু করে প্রাক্তন ছাত্র ও শুভানুধ্যায়ী— সকলেই আশ্বাস দিয়েছিলেন তাঁকে। কার্যত তাঁদের ভরসাতেই এখনও জনা তিরিশ আবাসিককে নিয়ে এগিয়ে চলেছে এই আশ্রম। শুধু এই সমস্ত শিশুদের শিক্ষাদানের মধ্যেই আশ্রমের কাজ সীমাবদ্ধ নেই এখন। সদ্য সুন্দরবনের বুকে আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড় আমপানে সুন্দরবনের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন অমল স্যার। লকডাউনের সময়েও বহু দুঃস্থ মানুষের জন্য কমিউনিটি কিচেন চালিয়েছেন আশ্রমে। তিনি বলেন, “অবসরের পরে যথেষ্ট চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু এখন আর চিন্তা করি না। কারণ আমার বিশ্বাস, যে কাজ আমি শুরু করেছি, সেটা ঠিক এগিয়ে যাবে।”
এলাকার বাসিন্দা নারায়ণ মান্না, ফারুক সর্দাররা বলেন, “ স্যারের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও এই আশ্রমের কাজে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েছি। উনি ছিলেন বলেই এই প্রত্যন্ত সুন্দরবনের বহু দুঃস্থ, অনাথ শিশু শিক্ষার আলো পেল।”
আশ্রমের আবাসিক বিপুল, ফেলু, বিক্রমরা বলে, “ স্যার ছিলেন বলেই আমরা আছি। না হলে কোথায় যে হারিয়ে যেতাম, কে জানে!’’ বড় হয়ে স্যারের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় বলে জানাল এই শিক্ষার্থীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন