ঝুঁকি নিয়েই চলে যাতায়াত।—নিজস্ব চিত্র।
দিনের বেলায় সেতুর উপরে এক ধারে সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। উল্টো দিকে দোকানপাট। বহু গাড়ি চলাচল করে। মানুষও হেঁটে পেরোয়। কিন্তু সেতুর উপরে বিদ্যুতের খুঁটি থাকলেও বেশির ভাগ আলোই জ্বলে না। সন্ধে ঘনালেই বসিরহাটের গুরুত্বপূর্ণ ইছামতী সেতু ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে যায়।
এই পরিস্থিতি যান চলাচল তো বটেই রাতে সেতু পেরনো ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেতুর উপরে প্রায়ই ছোটখাট দুর্ঘটনা ঘটছে। চুরি-ছিনতাই হচ্ছে। অথচ আলোর ব্যবস্থা করার কথা মাথায় নেই কারও। সেতুর উপর থেকে হকার উচ্ছেদ বা সেতুর উপরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলা বন্ধ করার দাবি থাকলেও সে দিকে নজর নেই পুলিশ-প্রশাসনের। সব মিলিয়ে ক্ষুব্ধ বসিরহাটবাসী।
বসিরহাটের মহকুমাশাসক শেখর সেন বলেন, ‘‘কয়েক দিন আগেও তো সেতুর উপর আলো জ্বলছিল। ইদানীং কেন আলো জ্বলছে না, সে বিষয়ে পুর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
বসিরহাট শহরের মাঝ বরাবর বয়ে যাওয়া ইছামতী নদীর উপরে ২০০১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন হয় ২৮০ মিটার লম্বা কংক্রিটের সেতুটির। ওই সেতু পার হলেই পড়বে সংগ্রামপুর-শিবহাটি পঞ্চায়েত। সেতুটির দায়িত্বে ছিল বসিরহাটের পূর্ত ও সড়ক দফতর। সেতুর উপরে রাস্তার দু’ধারে ফুটপাতের পাশ দিয়ে বেশ কয়েকটি বিদ্যুতের খুঁটি লাগিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হয়। কিছু দিন ঠিকঠাক আলো জ্বলেওছিল। সেতুর উপর যাতে গাড়ি না রাখা হয়, সে দিকেও কড়া নজরদারি ছিল শুরুতে। নিরাপত্তার কথা ভেবে সেতুর উপরে কোনও দোকান বসতে দেওয়া হয়নি।
কিন্তু ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে পরিস্থিতি। ওই সেতু পেরিয়ে ওল্ড সাথক্ষিরা রাস্তা ধরে কয়েক কিলোমিটার এগোলেই ইটিন্ডা পেরিয়ে ঘোজাডাঙা সীমান্ত। যার অন্য পাড়ে বাংলাদেশের ভোমরা। বর্তমানে ঘোজাডাঙা সীমান্ত দিয়ে বাণিজ্যের জন্য ইছামতী সেতুর উপর দিয়ে প্রতিদিন কয়েকশো পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করে। ফলে সেতুর গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে কমেছে নিরাপত্তা।
আরও একটি কারণে ইছামতী সেতু প্রশাসনের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। প্রায়ই ওই সেতুর উপর থেকে দুষ্কৃতী-সহ অবৈধ ভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আসা বাংলাদেশিরা ধরা পড়ে। গত কয়েক বছর আগে ইছামতী সেতুর নীচ থেকে বেশ কিছু জিলেটিন স্টিক উদ্ধার হয়েছিল। জঙ্গিদের পক্ষে সেতু উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি চিঠিও এসেছিল প্রশাসনে। ফলে বাড়তি নজর দেওয়া হবে, এটাই ছিল প্রত্যাশিত।
সেতুটির অবস্থানগত আরও কিছু গুরুত্ব আছে। এক পাশে পঞ্চায়েত ভবন, অন্য পাশে মহকুমাশাসকের বাংলো ও দফতর, আদালত, সেচ এবং পূর্ত দফতরের কার্যালয়, উপসংশোধনাগার, পুরভবন। সে কথা ভেবে ওই সেতুর এক পারে বোটঘাট এলাকায় পুলিশের পক্ষে একটি স্থায়ী চৌকিও করা হয়। কিন্তু এত সবের পরেও সেতুর উপরে গাড়ি রাখা চলছে। দোকানপাট বসছে। রাতে আলোর ব্যবস্থাও নেই। সেতুর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশাসনের এমন গা-ছাড়া ভাব দেখে ক্ষুব্ধ শহরবাসী।
গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে বাড়ি ফিরতে
রাত হয়ে যায়। সেতুর উপর দিয়ে
আসতে রীতিমতো ভয় লাগে।
কল্পনা বাছাড়, কাকলি মণ্ডল (ছাত্রী)
কয়েক দিন আগেও তো সেতুর
উপরে আলো জ্বলছিল।
এখন জ্বলছে না কেন খোঁজ নেব।
শেখর সেন (মহকুমাশাসক)
পূর্ত ও সড়ক দফতরের বক্তব্য, তাদের দায়িত্ব ছিল সেতু তৈরি করা। সেই কাজ হয়েছে। সেতুর নিরাপত্তা দেখা তাদের এক্তিয়ারভুক্ত নয়। পুরসভার পক্ষে বলা হয়, সেতুর এক পাশটা তাদের এলাকার মধ্যে পড়লেও অন্য দিক তো পঞ্চায়েতের। তাই গোটা সেতুতে আলোর ব্যবস্থা করা পুরসভার কাজ নয়। আর পঞ্চায়েতের দাবি, সেতুর উপরে লাগানো আলো অনেক দিন আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবে সেতুর উপরে পঞ্চায়েতের অংশে টিউব লাইট লাগানো হয়েছে।
মঙ্গলবার রাতে ইছামতী সেতুতে গিয়ে দেখা গেল, সর্বত্র গাঢ় অন্ধকার। তারই মধ্যে চলাচল করছেন অনেকে। তাঁদেরই এক জন স্বপন বৈরাগী বলেন, ‘‘দিনের বেলায় যখন কাজে যাই, তখন সেতুর রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ি। দোকানপাট বসে। জমজমাট এলাকা। আর রাতের বেলায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। দিনরাতে সব সময়েই প্রাণ হাতে নিয়ে চলাচল করতে হয়।’’
কাকলি মণ্ডল, কল্পনা বাছাড়দের মতে কয়েক জন ছাত্রীর কথায়, ‘‘বসিরহাট থেকে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। অন্ধকার সেতুর উপর দিয়ে সাইকেলে আসার সময়ে রীতিমতো ভয় লাগে। এক দিকে বেপরোয়া ভাবে বড় বড় ট্রাক চলে। সেতুর উপরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে-ছোকরাদের কটূ মন্তব্য ভেসে আসে। পুলিশের দেখা অনেক সময়েই মেলে না।’’
বসিরহাট পুরসভার প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা কংগ্রেস নেত্রী কৃষ্ণা মজুমদার বলেন, ‘‘সেতুর উপরে নিরাপত্তার কথা ভেবে আমাদের সময়ে পুরসভার পক্ষে আলো লাগানো হয়েছিল। এখন দেখছি, সে সব আলো আর জ্বলে না। আসলে মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে না ভাবায় এই অবস্থা।’’ বর্তমান পুরপ্রধান তপন সরকারের বক্তব্য, ‘‘সেতুর একটা অংশে আলোর দায়িত্ব পুরসভার। অন্য অংশ পঞ্চায়েতের। তবে যাতে দু’চার দিনের মধ্যে গোটা সেতুটা আলোকিত হয়, তা দেখা হচ্ছে।’’ এসডিপিও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘দিনরাত সেতুর উপরে পুলিশি টহল জারি রাখা হয়েছে। সেতুর উপরে গাড়ি রাখা কিংবা দোকান করার চেষ্টা করা হলে পুলিশকে কড়া ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।’’ হকার উচ্ছেদ এবং বেআইনি পার্কিং নিয়ে শেখরবাবুর বক্তব্য, ‘‘সেতুর উপরে কোনও গাড়ি যাতে দাঁড় করিয়ে রাখা না হয় এবং দোকানদারি বন্ধ করা হয়, সে বিষয়ে প্রথমে সকলকে সাবধান করা হবে। তাতেও কাজ না হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।’’