গাইঘাটা

প্রাচীন মন্দিরকে ঘিরে বাড়ছে পর্যটন ব্যবসা

জলেশ্বরের প্রাচীন শিব মন্দির। আর তাকে ঘিরেই সারা বছর বহু মানুষের আনাগোনা হয় গাইঘাটায়। মন্দিরকে কেন্দ্র করেই এলাকার অর্থনৈতিক চিত্র বদলাতে শুরু করেছে।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৫ ০০:৫৫
Share:

এই সেই প্রাচীন গোবিন্দ মন্দির। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

জলেশ্বরের প্রাচীন শিব মন্দির। আর তাকে ঘিরেই সারা বছর বহু মানুষের আনাগোনা হয় গাইঘাটায়। মন্দিরকে কেন্দ্র করেই এলাকার অর্থনৈতিক চিত্র বদলাতে শুরু করেছে।

Advertisement

মন্দির ও পর্যটন উন্নয়ন কমিটির কার্যকরী সম্পাদক সহদেব চক্রবর্তী জানালেন, সেন বংশের রাজত্বকালে দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে শিব পুজোর প্রচলন শুরু হয় এই এলাকায়। তখন একটি বিগ্রহ পুজো হতো। মন্দিরটি ছিল টিনের ছাউনি ও দেওয়ালে ছিল কাদা ইটের গাঁথনি। পরে গোবরডাঙার জমিদার রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শিব মন্দিরের জন্য ৬০ বিঘে জমি দান করেছিলেন।

প্রাচীন মূল বিগ্রহটি অবশ্য এখন বছরের নির্দিষ্ট দিন ছাড়া দেখা যায় না। মন্দিরের পাশেই রয়েছে চার একর ৪০ শতক জমির উপরে একটি পুকুর, যা পরিচিত ‘শিব পুকুর’ নামে। বছরভর পুকুরের নীচে রাখা থাকে বিগ্রহটি। কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, চড়কে যাঁরা সন্ন্যাসী হন, তাঁরা প্রতি বছর চৈত্র মাসের তৃতীয় সোমবার শিব পুকুর থেকে বিগ্রহ তুলে আনেন। পরের দিন ওই বিগ্রহ নিয়ে সন্ন্যাসীরা পায়ে হেঁটে হালিশহরে গিয়ে বিগ্রহকে গঙ্গায় স্নান করান। ফিরে স্থানীয় আটটি গ্রামের ভক্তদের বাড়িতে পূজিত হন দেবতা। ১ বৈশাখ বিগ্রহকে ফের শিব পুকুরে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।

Advertisement

সারা বছর ধরেই এখানে দূর-দূরান্ত থেকে মন্দির দর্শনে আসেন বহু ভক্ত। মূল একটি শিব মন্দির ছাড়াও এখানে রয়েছে শিবের প্রতীক্ষা মন্দির ও একটি কালী মন্দির। বছরে তিনটি মেলা বসে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় করেন। মূল শিব মন্দিরটি সংস্কার করে নতুন করে তৈরির কাজ শুরু হয়েছে বছর দু’য়েক আগে। কিছু দিনের মধ্যেই তা শেষ হওয়ার কথা। একটা সময় শিব মন্দিরের জমি জবর দখল হয়ে যাচ্ছিল। স্থানীয় আটটি গ্রামের মানুষজনই তা ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন।

মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে এলাকাটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলারও উদ্যোগ আছে। তৈরি করা হয়েছে পিকনিক স্পট। শীতের মরসুমে সেখানেও অনেকে ভিড় করেন, মন্দিরে পুজোও দেন। কমিটির পক্ষ থেকে তৈরি করা হয়েছে বিনোদন পার্ক। শিবমন্দির ঘুরে দেখা গেল, বড় বড় মাটির ঢিবি। সহদেববাবু বলেন, ‘‘ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, এখানে বহু বছর আগে বৌদ্ধ গ্রাম ছিল। ঢিবিগুলি তারই নিদর্শন বহন করে চলেছে।’’

স্থানীয় ইছাপুর দোলখোলাতে একটি প্রাচীন গোবিন্দ মন্দির গাইঘাটার ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের নিদর্শন।শু ধু গাইঘাটা নয়, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অন্যতম প্রাচীন মন্দির ও টেরাকোটা স্থাপত্যের নিদর্শন ওই গোবিন্দ মন্দির। স্থানীয় ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, বহু যুগ পূর্বে জনৈক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত রাঘব সিদ্ধান্তবাগীশ ইছাপুরে (তৎকালীন নাম কুশদ্বীপ) জমিদারি পত্তন করেন। এক দিকে, যমুনা অন্য দিকে, চালুন্দিয়া নদী দিয়ে ঘেরা ছিল ওই জনপদ। ১৫৮০-৮৩ সাল নাগাদ মোঘল সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেন রাঘব। রাজানুকুল্যে তিনি ‘চৌধুরী’ উপাধি পান। তাঁর পৌত্র রঘুনাথ ১৬৫১ সাল নাগাদ ওই ত্রিতল গোবিন্দ মন্দিরটি তৈরি করেন।

পরবর্তী সময়ে কালের নিয়মে মন্দিরটি প্রায় ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়। কয়েক বছর আগেও ওই মন্দিরটি মাটির ঢিবির তলায় ঢাকা পড়েছিল। বন-জঙ্গলে ভরে ছিল। কয়েক বছর আগে চৌধুরী পরিবারের চতুর্দশ বংশধর অখিলেশ চৌধুরী উদ্যোগী হয়ে ওই মন্দির থেকে মাটি সরানোর মাধ্যমে সংস্কারের কাজ শুরু করেন। স্থানীয় বাসিন্দারাও সহযোগিতা করেন। মন্দিরের গা থেকে মাটি সরতেই বেরিয়ে পড়ে অপূর্ব টেরাকোটার কাজ। দেওয়ালে দেবদেবী, কৃষ্ণলীলার দৃশ্য। রয়েছে নানা জ্যামিতিক নকশাও।

২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বিষয়টি জানতে পেরে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার পর্যবেক্ষক দল ইছাপুরে এসে মন্দিরটি দেখে যান। তাঁরা জানিয়েছিলেন, গোটা জেলায় ওই গোবিন্দ মন্দিরটি টেরাকোটার স্থাপত্যের নিদর্শনগুলির মধ্যে সেরা বিবেচিত হতে পারে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে অখিলেশবাবুকে চিঠি দিয়ে আরও জানানো হয়েছিল, মন্দিরটির শিল্পকলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানকার ভাস্কর্যে স্থান পেয়েছে ড্রাগনও। হিন্দু ও বৌদ্ধ শিল্প আঙ্গিকের ছাপ আছে এর নির্মাণে। প্রসঙ্গত, ডেভিড ম্যাককাচ্চনও তাঁর ‘দ্য লেট মিডিয়াভেল টেম্পলস অব বেঙ্গল’ গ্রন্থে ওই মন্দিরের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করছেন। রাজ্য হেরিটেজ কমিশন ইতিমধ্যেই মন্দিরটিকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করেছে। কমিশনের পক্ষ থেকে মন্দিরটির কিছুটা সংস্কারের কাজও হয়েছে। তবে অসম্পূর্ণ। স্থানীয় বাসিন্দা আশিস দত্ত বলেন, ‘‘মূল মন্দিরের তিন ভাগের একভাগ এখন দেখতে পাওয়া যায়। মন্দিরটির ন’টি চূড়া ছিল। সে কারণে একে নবরত্ন মন্দিরও বলা হয়।’’

১৯২০ সাল নাগাদ পুরনো ওই মন্দিরটির পাশেই নতুন একটি মন্দির তৈরি করা হয়েছে চৌধুরী পরিবারের পক্ষ থেকে। সেখানে ২ ফুট উচ্চতার কষ্টিপাথরের একটি গোবিন্দ বিগ্রহ আছে। কিন্তু এলাকার মানুষের যাবতীয় গর্ব প্রাচীন মন্দিরটিকে নিয়েই। অখিলেশবাবু বলেন, ‘‘হেরিটেজ কমিশনের উদ্দেশ্য, পুরনো স্থাপত্যকে পুরনো আদলে ফিরিয়ে দেওয়া। কিন্তু এখানে কিছুটা সংস্কারের কাজ হলেও মন্দিরের উপরের ন’টি চূড়া তৈরি করা হয়নি। ওই চূড়াগুলি তৈরি না হলে মন্দিরটি তার অতীত ঐতিহ্য ফিরে পাবে না।’’ বাসিন্দারা জানালেন তাদের দাবি, মন্দির সংস্কারের বাকি কাজ হেরিটেজ কমিশন দ্রুত শেষ করুক।

গাইঘাটায় আরও একটি দর্শনীয় স্থান হল, মতুয়াদের পীঠস্থান ঠাকুরবাড়ি। প্রতি বছর মতুয়া ধর্ম মহামেলা উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয় এখানে। ঠাকুর পরিবারের সদস্য প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ১৯৪৮ সালে ঠাকুরনগর তৈরি করেন।

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন