বেআইনি কারবার, মাটির নীচে জলের ভাঁড়ারে টান

পাড়ায়-পাড়ায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে জল তৈরির কারখানা। মাটির নীচের জল পরিশোধিত করে বিক্রি করা হচ্ছে। কিছু মানুষের পানীয় জলের প্রয়োজন মিটছে। কিন্তু তার জন্য যথেচ্ছ ভাবে তোলা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ জল।

Advertisement

সমীরণ দাস

জয়নগর শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৩০
Share:

বাজারের-পথে: বিক্রির কমতি নেই বোতলবন্দি জলের। ছবি: সুমন সাহা

কুড়ি লিটার জলের দাম মাত্র ১০ টাকা। বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসলে আরও কুড়ি টাকা। কার্যত জলের দরেই বোতলবন্দি পানীয় জল মিলছে দক্ষিণ শহরতলি ও গ্রামাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায়।

Advertisement

পাড়ায়-পাড়ায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে জল তৈরির কারখানা। মাটির নীচের জল পরিশোধিত করে বিক্রি করা হচ্ছে। কিছু মানুষের পানীয় জলের প্রয়োজন মিটছে। কিন্তু তার জন্য যথেচ্ছ ভাবে তোলা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ জল। মাটির নীচের জলের বেআইনি লাগামছাড়া ব্যবহারে ভবিষ্যতে জলস্তর কমে গিয়ে বড় বিপদের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞেরা।

বারুইপুর থেকে শুরু করে জয়নগর, কুলতলি-সহ দক্ষিণের বিস্তীর্ণ এলাকা ছেয়ে গিয়েছে এই ধরনের কারখানায়। এমনকী, সুন্দরবনের প্রত্যন্ত বালিদ্বীপেও মাটির নীচের জল এ ভাবে তুলে বোতলবন্দি করে বিক্রি করা হচ্ছে। স্থানীয় সূত্রের খবর, শুধু বারুইপুর এলাকাতেই এই ধরনের জলের কারখানা রয়েছে অন্তত ১৫টি। এক ব্যবসায়ী জানালেন, হু হু করে বিকোচ্ছে বোতলবন্দি জল। দোকান, অফিস থেকে শুরু করে গৃহস্থ বাড়ি, সর্বত্র এই জলই ব্যবহার হচ্ছে। এক-একটি কারখানা থেকেই প্রতিদিন অন্তত শ’খানেক কুড়ি লিটারের জার বাজারে বেরোচ্ছে।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কোনও রকম ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে কারখানাগুলি। নেই জলের গুণগতমানের জন্য প্রয়োজনীয় শংসাপত্রও। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, যন্ত্রের সাহায্যে মাটির তলা থেকে পাম্প করে জল তোলাটাই বেআইনি। সুতরাং এই সব কারখানার প্রশাসনিক ছাড়পত্রের প্রশ্নই নেই। আর জলের পরিস্রুতকরণ কতটা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তো আছেই।

গোচরণ এলাকার এক জল কারখানার মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মাটির নীচ থেকে জল তোলার বিধিনিষেধের ব্যাপারে ধারণাই নেই। জয়নগরের নারায়ণীতলা পঞ্চায়েত এলাকায় একাধিক এই ধরনের কারখানা চলছে। তবে পঞ্চায়েতপ্রধান অশোক সাহা জানান, পঞ্চায়েতের তরফ থেকে এই ধরনের কোনও কারখানাকেই ব্যবসা করার ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি।

প্রশ্ন উঠছে, এই জলের এত চাহিদা কেন?

স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, অধিকাংশ এলাকাতেই বাড়িতে বাড়িতে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানীয় জল পৌঁছনোর ব্যবস্থা নেই। টিউবওয়েল থাকলেও তা থেকে ভাল জল ওঠে না অনেক জায়গাতেই। বাধ্য হয়েই মানুষ ভরসা করছেন বোতলের জলের উপরে। বারুইপুরের হরিহরপুর পঞ্চায়েতের বাসিন্দা পবিত্র মণ্ডল বলেন, ‘‘পানীয় জলের অন্য কোনও উৎস নেই। ফলে এই জল নিতেই হয়। কোম্পানির লোক বাড়িতে জারে করে জল পৌঁছে দিয়ে যায়। জলের মানও খারাপ নয়।’’

অনেকেই বলছেন, জলে গুণগত সমস্যা নেই। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে অন্য জায়গায়। ভূগর্ভস্থ জলের যথেচ্ছ ব্যবহারে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন বিশেষজ্ঞেরা। পরিবেশ কর্মী সুভাষ দত্ত বলেন, ‘‘এই ভাবে জল তোলাটা পরিবেশের উপরে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। কয়েক বছর আগের একটা পর্যবেক্ষণে দেখা গিয়েছে, কলকাতা-সহ সংলগ্ন এলাকার জলস্তর অনেক কমে গিয়েছে।’’

এই সব কারখানায় জল পরিশোধনের মান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সুভাষবাবু। বলেন, ‘‘এই জল পরীক্ষা করে দেখা উচিত, সত্যি সত্যি কতটা পরিস্রুত। অনেক সময়ে খেয়ে বোঝা যায় না। কিন্তু শরীরে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ে।’’

আর এইখানেই প্রশ্ন উঠছে প্রশাসনিক ভূমিকা নিয়ে। পরিবেশ সচেতন নাগরিকেরা চাইছেন এই ধরনের কারখানা নিয়ন্ত্রণ করা হোক। কিন্তু অভিযোগ, এ ক্ষেত্রে কোনও উদ্যোগ নেই প্রশাসনের। বারুইপুর থানার এক আধিকারিক বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ নেই। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন