দম্পতি: স্বপ্না ও বিশ্বজিৎ মণ্ডল
সকালে মেয়েদের পড়তে যেতে বারণ করেছিলেন মা। বলেছিলেন, ‘‘কিছু ভাল লাগছে না রে। আজ আর যাস না।’’ অভয় দিয়েছিলেন বাবা। ‘আমি আছি তো। তোরা যা’ বলে মেয়েদের পাঠিয়ে দেন।
টিউশন থেকে বাড়ি ফিরে দুই মেয়ে দেখে, বাড়ি তালাবন্ধ। পড়শিরা পরে দরজা ভাঙায় দেখা যায় পড়ে আছে তাদের মায়ের দেহ। তখনই খবর আসে, ট্রেনের ধাক্কায় জখম হয়েছেন বাবাও।
বৃহস্পতিবার সকালে এমন ঘটনায় হইচই পড়ে যায় হালিশহরের যদুনাথবাটি এলাকায়। পুলিশ জানায়, মৃতার নাম স্বপ্না মণ্ডল (৩৫)। তাঁর স্বামী বিশ্বজিৎ মণ্ডল গুরুতর জখম অবস্থায় কল্যাণীর জেএনএম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
বীজপুর থানার পুলিশের অনুমান, স্বপ্নাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে। ওই মহিলার বাপের বাড়ির লোকজন পুলিশকে অভিযোগ করেছেন, বিশ্বজিৎই খুন করেছে স্বপ্নাকে। ইদানীং সন্দেহের বশে স্বপ্নাকে মারধর করতেন তিনি। মেয়েরাও পুলিশকে জানিয়েছে সে কথা। ময়না-তদন্তের রিপোর্ট পেলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আরও পড়ুন: ঘোরেই রয়েছেন কুশমণ্ডির নির্যাতিতা
বিশ্বজিতের বাড়ি হালিশহরের হাজিনগরে। তেরো বছর আগে তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় স্বপ্নার। স্বপ্নার দ্বিতীয় স্বামী বিশ্বজিৎ। বিশ্বজিতের সঙ্গে বিয়ের সময়ে শ্রাবণী নামে স্বপ্নার আগের পক্ষের বছরখানেকের একটি মেয়ে ছিল। পরে স্বপ্নার আরও একটি মেয়ে হয়। বছর বারোর সেই মেয়ের নাম শ্রেয়ষী। শ্রাবণীর বয়স চোদ্দো। দু’জনেই স্থানীয় স্কুলে পড়ে। বিশ্বজিৎ ব্যারাকপুরে একটি গাড়ির শো-রুমের কর্মী।
স্বপ্নার দুই মেয়ে জানিয়েছে, মা-বাবার মধ্যে নিয়মিত অশান্তি হত। বিশ্বজিৎ মারধরও করতেন স্বপ্নাকে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবার রাতেও তাঁদের মধ্যে অশান্তি হয়। সম্ভবত কিছু আঁচ করেছিলেন স্বপ্না। এ দিন সকালে সে জন্যই মেয়েদের টিউশন পড়তে যেতে নিষেধ করেন। বলেন, তাঁর শরীরটা খারাপ। কিন্তু মেয়েদের এক রকম জোর করেই পড়তে পাঠান বিশ্বজিৎ।
মেয়েরা ফিরে এসে দেখে, বাড়ির বাইরে থেকে তালা দেওয়া। কাছেই তাদের মামার বাড়ি। মায়ের খোঁজে সেখানে যায় তারা। কিন্তু সেখানেও খোঁজ মেলেনি। পাড়ার কোথাও মাকে খুজে না পেয়ে স্বপ্নার মোবাইলে ফোন করে মেয়েরা। ফোন বেজে যায়। বিশ্বজিতের ফোন বন্ধ ছিল। সেই সময়ে পাড়ার লোকের সন্দেহ হওয়ায় তাঁরা তালা ভেঙে বাড়িতে ঢোকেন। দেখা যায়, রান্না ঘরের মেঝেতে পড়ে স্বপ্নার নিথর দেহ। খবর যায় থানায়।
পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করে। তারই মাঝে খবর আসে হালিশহর স্টেশনে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে জখম হয়েছেন বিশ্বজিৎ। স্থানীয় মানুষজন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন প্রথমে আপ লাইনে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বিশ্বজিৎ। কিন্তু কয়েকজন তাঁকে ধরে ফেলেন। তখনকার মতো লাইনের ধার থেকে চলে যান বিশ্বজিৎ। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে ডাউন লাইনে গিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেন। ছিটকে লাইনের পাশে পড়েন।
বিশ্বজিতের বোন সুপ্রিয়া চক্রবর্তী অবশ্য পুরো ঘটনার জন্য স্বপ্নাকেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘ওদের বিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে প্রথমে মেনে নেয়নি। পরে মেনে নিলে ওরা হাজিনগরের বাড়িতে ফেরে। কিন্তু কিছু দিন পরে ফের যদুনাথবাটিতে বাড়ি ভাড়া করে চলে যায়।’’ তিনি জানান বাড়ির সঙ্গে বিশ্বজিৎদের কার্যত কোনও যোগাযোগ ছিল না। তবে তাঁদের দুই মেয়ে মাঝে মধ্যে হাজিনগরের বাড়িতে আসত। তাঁর অভিযোগ, বিশ্বজিতের সঙ্গে স্বপ্না ভাল ব্যবহার করতেন না। খেতে দিতেন না। স্বপ্না বাইরে কাজ করতেন। তা বিশ্বজিতের পছন্দ ছিল না।