আজ শেষ নাগ মেলা, নতুন সাজের প্রস্তুতি

সবাই সাগরদ্বীপকে চেনে গঙ্গাসাগরের মেলাকে দিয়ে। কিন্তু সাগর ও তার আশেপাশের মানুষের একই রকম ভিড় জমান আর একটি মেলায়। তার নাম নাগমেলা। প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসে এই মেলা হয় পুরুষোত্তমপুরে নাগ সরোবর ময়দানে। প্রতি বছর যেন এই মেলার জাঁকজমক বাড়ছে।

Advertisement

শিবনাথ মাইতি

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৪
Share:

সাগরে নাগমেলায় প্রতিমা। —নিজস্ব চিত্র।

সবাই সাগরদ্বীপকে চেনে গঙ্গাসাগরের মেলাকে দিয়ে। কিন্তু সাগর ও তার আশেপাশের মানুষের একই রকম ভিড় জমান আর একটি মেলায়। তার নাম নাগমেলা। প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসে এই মেলা হয় পুরুষোত্তমপুরে নাগ সরোবর ময়দানে। প্রতি বছর যেন এই মেলার জাঁকজমক বাড়ছে। বছর দুয়েক আগেও যেখানে জেনারেটার আর হ্যাজাকের আলোই ছিল ভরসা, সাগরে বিদ্যুত্‌ আসার পর এখন সেখানেই সকলকে চমকে দিচ্ছে চন্দননগরের বাহারি আলো। চওড়া হয়েছে রাস্তাও। আগে ছিল ইঁট-পাতা রাস্তা, বড়জোড় হাত তিনেক চওড়া। বছর খানেক তৈরি হয়েছে ছ’ফুট চওড়া পিচের পাকা রাস্তা। দিব্যি চলছে ভ্যানো, ম্যাটাডোর। ফলে বেড়েছে লোকের সংখ্যাও। ছ’দিনের মেলার শেষ দিনগুলোয় রোজ লক্ষাধিক লোক আসছেন। আজ, রবিবার, মেলা শেষ হচ্ছে।

Advertisement

বেড়েছে মেলার আয়তনও। যেখানে মেরেকেটে ৫০-৬০টা দোকান হত, এ বার সেখানে আড়াইশো ছাড়িয়েছে। মেলার চিরপরিচিত কচুরি, গজা, জিলিপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মোমো, চাউমিন, এগ রোলের দোকান। প্রতিদিন রাতে চলছে হরেক অনুষ্ঠান। কখনও থিয়েটার, কখনও নাচগান। কলকাতা থেকে এ বার এসেছিল করুণাময়ী অপেরা, শুভদীপ অপেরা, অগ্নিবীণা অপেরা, স্টার অপেরা। মনসা গান, বাউল গান, এলাকার শিশুশিল্পীদের অনুষ্ঠান, সবই মাতিয়ে রেখেছিল মেলায় আসা মানুষকে।

নাগ মেলার এমন রমরমা দেখে প্রশাসনও উত্‌সাহিত। এই মেলার জমিকে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে, জানালেন মেলা কমিটির সহ-সভাপতি রবীন্দ্রনাথ দে এবং পরেশ চন্দ্র শ্যামল। তাঁরা সুন্দরবন পর্যটন উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান তথা স্থানীয় বিধায়ক, বঙ্কিম হাজরার কাছে এ বিষয়ে আবেদন জানান। বঙ্কিমবাবু বলেন, “একটি প্রাথমিক হিসেব কষে সেই প্রকল্প গঙ্গাসাগর-বকখালি ডেভলপমেন্ট অথরিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলেই জেলা পরিষদের অধীনে কাজ শুরু হবে।”

Advertisement

পরিকল্পনার দায়িত্বে থাকা ইঞ্জিনিয়ার প্রীতম জানা জানান, নাগ সরোবরের চারপাশে ৮ ফুট চওড়া ফুটপাথ তৈরি, সরোবরের পাড় বাঁধানো, ছোটদের জন্য পার্ক গড়া, এ সবই আছে পরিকল্পনায়। এ ছাড়া সরোবর সংলগ্ন রাস্তাগুলি পাকা করা, রাস্তায় ত্রিফলাবাতি বসানো, পুণ্যার্থীদের সুবিধার জন্য সরোবরের চার পাশে বসার জায়গা, বিশ্রামের জন্য নাট মন্দির প্রভৃতি তৈরির ব্যবস্থা, এমন পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরোবরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য বোটের ব্যবস্থা করা হবে। সব মিলিয়ে খরচ ধরা হয়েছে অন্তত চার কোটি টাকা। ইতিমধ্যেই সরোবর সংলগ্ন জমি মাপজোকের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। উদ্যোক্তাদের আশা, এই সংস্কারগুলি হয়ে গেলে কেবল মেলার ক’দিন নয় সারা বছরই পুণ্যার্থীদের ভিড় থাকবে। যার ফলে দুটো বাড়তি পয়সার মুখ দেখবেন স্থানীয় মানুষ।

নাগ মেলার ঐতিহ্যও অবশ্য এর এক প্রধান আর্কষণ। মেলা উদ্যোক্তারা জানালেন, বাংলার ১৩৮৭ সালে ওই মেলার সূচনা। সেই সময় সাগরে সর্পদষ্ট হয়ে প্রচুর মানুষ মারা যেতেন। তাই নাগ দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য মনসাদ্বীপ রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ স্বামী সিদ্ধিদানন্দ, স্থানীয় চিকিত্‌সক শুভেন্দু রায়, নাট্যকার সীতানাথ মাইতি-সহ অন্যান্যদের চেষ্টায় ওড়িশার কটক থেকে পুজোর ‘ধ্যান’ (নিয়মনীতি) নিয়ে এসে নাগ দেবতার পুজো শুরু হয়। স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস, তারপর থেকেই সাগরে সাপের উপদ্রব কমেছে। ক্রমশ লোকমুখে সেই বিশ্বাস সাগরের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। তাই প্রত্যেক বছরই মেলা দেখতে লক্ষাধিক মানুষ ভিড় জমান।

পুজো উদ্যোক্তারা জানালেন নদিয়া, দুই ২৪ পরগনা, দুই মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি থেকেও প্রচুর দর্শনার্থী মেলায় আসেন। মেলার ভিজিট বুকে জ্বলজ্বল করছে বিদেশিদের নামও। প্রতিবছর মেলায় প্রচুর জন সমাগমের কথা মাথায় রেখে মেলা প্রাঙ্গণকে একটি সুসংহত পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মেলা উদ্যোক্তারা মেলা কমিটির সহ-সভাপতি রবীন্দ্রনাথ দে, পরেশ চন্দ্র শ্যামল জানান, মন্দিরে নিত্য পুজো হয়। তাই সারা বছরই পুণ্যার্থীদের ভিড় লেগে থাকে। দূরদূরান্ত থেকে বহু ভক্ত মন্দিরে পুজো নিয়ে আসেন। কিন্তু তাঁদের বিশ্রামের কোনও সুব্যবস্থা নেই। নাট মন্দির না থাকায়, মন্দির সংলগ্ন এলাকা এখনও কাঁচা হওয়ায় বর্ষাকালে তাঁদের খুব দুর্ভোগে পড়তে হয়। রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন, “পুণ্যার্জনের আশায় সাগরে কপিল মুনির মন্দিরে যাঁরা আসেন, তাঁদের কেউ কেউ নাগ মন্দিরও ঘুরে যান। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সেই সংখ্যাটা আরও বাড়বে।”

স্থানীয় বাসিন্দা মুক্তি সাউ জানান, প্রতি বছর সাগরের বুকে মকর সংক্রান্তির দিন সাগর মেলা হলেও তাতে স্থানীয় মানুষ সেভাবে যোগ দিতে পারেন না। বাইরের লোকের চাপে তাঁরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। কিন্তু নাগ মেলায় সাগরদ্বীপের সব মানুষই স্বতস্ফূর্তভাবে যোগ দেন। তিনি বলেন, “নাগ মেলা প্রাঙ্গন যদি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে তাহলে আমাদের কাছেও তার আকর্ষণ আরও বাড়বে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন