অঙ্কন: অশোক মল্লিক।
টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে হাতসাফাই? তা আবার হয় নাকি? প্রতিদিনের অভ্যাস মতো বছর পঁচিশের যুবকটি বিনা টিকিটেই বারাসত থেকে চড়ে বসেছিল মাঝেরহাট-হাসনাবাদ লোকালে। সকালের দিকে টিকিট কাটার রেওয়াজ এমনিতেই কম। তার উপরে পকেটমার বলে কথা। টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে ব্যবসা চালালে ভাই-বেরাদরদের কাছে সম্মান থাকে না।
কিন্তু মঙ্গলবার পড়বি তো পড় এক্কেবারে টিকিট চেকারের খপ্পরে। ফাইনও দিতে হয়েছে দস্তুর মতো। কিন্তু তারপর থেকেই শুরু হয় ছোকরার গজগজানি। ‘কাজটা ভাল করলেন না স্যার’ অনেক বার টিকিট চেকারের কানের কাছে সে কথা ঘ্যান ঘ্যান করে গিয়েছে। টিকিট চেকার বয়সে নবীন। বিনা টিকিটের যাত্রীকে রেয়াত করার প্রশ্নই নেই, বার বারই জানিয়ে দিয়েছেন কড়া গলায়।
বেলা তখন প্রায় সাড়ে ১১টা। নিজের মনে কাজ করে চলেছিলেন চেকারবাবু। একে ধমকাচ্ছেন, তাকে চমকাচ্ছেন। কেউ সুরসুর করে ফাইনের টাকা বের করে দিচ্ছে। কেউ গাঁইগুঁই চালিয়ে যাচ্ছে সমানে। বহু টাকা ফাইন উঠে গিয়েছে তত ক্ষণে। চেকারের প্যান্টের পিছনের পকেটে উপচে পড়ছে টাকা। এমনই চলছিল বেশ খানিক ক্ষণ। এ দিকে, পটেকমারও চেকারের পাশ ছাড়ছিল না। কখনও কাকুতি-মিনতি, কখনও শাসানি এ সবই চলছিল।
ট্রেন সবে ষন্ডালিয়া স্টেশন ছাড়ছে। ভিড় কামরার মধ্যে আচমকাই চেকারের পকেট থেকে এক থোক টাকা তুলে লাফ দিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দেয় ওই যুবক। রে রে করে ওঠে গোটা কামরা। দরজার বাইরে ঝুলতে ঝুলতে চেকার চিত্কার শুরু করেন। বলেন, “ওরে অনেকগুলো টাকা। ফেরত দিয়ে যা ভাই। তোর ফাইন আমি মকুব করে দিচ্ছি।”
কিন্তু সে কাকুতি-মিনতি তত ক্ষণে পকেটমারের কানে গেলে তো হয়! সে তখন লাইনের পাশ দিয়ে দৌড় দিয়েছে উল্টো দিকে। যাত্রীদের কাছেও চেকার অনুরোধ জানান, আপনারা একটু নামুন না ট্রেন থেকে। কিন্তু এত ক্ষণ ধরে গম্ভীর মুখে সরকারি দায়িত্ব সেরে তত ক্ষণে কামরার অনেকেরই বিরাগভাজন হয়েছেন চেকার-সাহেব। অনেককে ফাইন গুণতে হয়েছে। কাজেই কেউ আর চেকারের অনুরোধে কান দেননি। মাঝে মধ্যে মুখে চুকচাক আওয়াজ করে অনেকে বলেছেন বটে, “আপনার তো বড্ড লোকসান হয়ে গেল” কিন্তু ওটুকুই সার। চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে পকেটমারের পিছু ধাওয়া করার মতো টারজানগিরি ফলাননি কেউ। তা ছাড়া, চেকারের টাকা পকেটমারি হওয়ায় নির্মল আনন্দও পেয়েছেন অনেকে। টিপ্পনি ভেসে এসেছে, “অনেক টাকা এ হাত ও হাত করেন সারা বছর। এ বার নিজে গুণাগার দিন!” রাজা মণ্ডল ছিলেন ওই কামরায়। আসছিলেন হাসনাবাদের দিকে। ওই যাত্রী জানান, মোবাইলে নিজের একাধিক সহকর্মীকে ফোনের পর ফোন করছিলেন ওই চেকার। বলছিলেন, কিছু একটা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। কিন্তু তত ক্ষণে পকেটমার তো পগারপার!
ঘটনার অভিযোগ দায়ের হয়েছে বারাসত জিআরপি থানায়। সারা দিনে চলন্ত ট্রেনে এমন বহু ঘটনার সাক্ষী বসিরহাট-শিয়ালদহ শাখার ট্রেনের নিত্যযাত্রীরা। অভিযোগ জানিয়ে যে বিশেষ লাভ হয় না, সে ব্যাপারটাও এক রকম গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে তাঁদের। তবে খোদ চেকারের পকেট থেকে সরকারি আদায়ের টাকা খোওয়া যাওয়ার ঘটনায় জিআরপি কতটা নড়ে বসে, এখন সেটাই দেখার।
চেকার ভদ্রলোক অবশ্য রীতিমতো ভেঙে পড়েছেন। বললেন, “সামান্য টাকা ফাইন করেছিলাম ছেলেটাকে। টিকিট না কাটলে করতে তো হতই। এটাই তো আমার কাজ। কিন্তু সে যে এত বড় কাপ্তান, তা তো আগে বুঝিনি!”