(উপরে বাঁ দিকে) আয়রন গেট স্পোর্টিং ক্লাব। (ডান দিকে) পাইকপাড়া সবুজ সঙ্ঘ। (নীচে বাঁ দিকে) প্রতাপগড় স্পোর্টিং ক্লাব। (ডান দিকে) অভিযান সঙ্ঘ। নিজস্ব চিত্র।
কোথাও মণ্ডপ তৈরি হয়েছে মরিশাসের তামিল হিন্দু মন্দিরের আদলে। কোথাও আবার বৃন্দাবনের চন্দ্রোদয় মন্দিরের আদল। থিম পুজোয় উঠে এসেছে সাম্প্রতিক নেপালের ভূমিকম্প, আদিবাসীদের জীবনযাত্রা বা মৃত্যুর পরে যমালয়ে মানুষের কর্মফলের বিচার।
মণ্ডপ তৈরির উপকরণ হিসাবে কোথাও বেছে নেওয়া হয়েছে হোমিওপ্যাথি ওষুধের বোতল, পাথর, সমুদ্রিক উপকূলে জন্মানো নানা রকম ফল, পেনসিল, ঠান্ডা পানীয় খাওয়ার স্ট্র, পাট, বিচুলি ইত্যাদি। প্রতিমা নয়, মণ্ডপই বরং বেশির ভাগ পুজো উদ্যোক্তাদের কাছে বাড়তি গুরুত্ব পায় এখানে।
সব মিলিয়ে এ বার জমজমাট বনগাঁ শহরে পুজোর আয়োজন। দীর্ঘদিন ধরেই এই সীমান্ত শহরের পুজো গোটা রাজ্যের মানুষের নজর কেড়েছে। ঐতিহ্য, পরম্পরা ও থিমের মিশেলে পুজোর খ্যাতি ছড়িয়েছে ও পার বাংলাতেও। সেখান থেকেও বহু মানুষ বনগাঁ শহরের পুজো দেখে তবে যান কলকাতায় ঠাকুর দেখতে।
শহরের পুজোর আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল, পুজোকে কেন্দ্র করে বহু সাহিত্য পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশ। এ বারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বড় পুজোর উদ্যোক্তারাও পুজোর পাশাপাশি এ বারও ভাল মানের ‘সুভ্যেনিয়র’ বা ‘স্মরণিকা’ প্রকাশ করেছে।
দর্শক টানার প্রতিযোগিতায় এ বার ইছামতীর একপাড়ে প্রথম দিকে থাকবে আয়রন গেট স্পোর্টিং ক্লাব। তাদের মণ্ডপ তৈরি হয়েছে বৃন্দাবনের চন্দ্রোদয় মন্দিরের আদলে। উচ্চতা প্রায় তিনশো ফুট। চওড়া ১১০ ফুট। কাঁথির শিল্পীরা জোর কদমে এখন মণ্ডপ তৈরিতে ব্যস্ত। মণ্ডপের ভিতরে থাকছে সমুদ্রের পাড়ে জন্মানো হাজারো গাছগাছালির ফল দিয়ে তৈরি কারুকার্য। প্রতিমা কৃষ্ণনগরের। আলো আসছে চন্দননগর থেকে। দুবাইয়ের একটি হোটেলের আদলে আলসো দিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘টাওয়ার গেট’।
মতিগঞ্জ ঐক্যসম্মিলনী ক্লাব তাদের ৪৯তম বর্ষে কয়েক লক্ষ হোমিওপ্যাথি শিশি, পাথর, কাচ দিয়ে মরিশাসের তামিল হিন্দু মন্দিরের আদলে ১০৯ ফুট উচ্চতার মণ্ডপ তৈরি করছে। মণ্ডপ তৈরি করছেন স্থানীয় শিল্পী বছর তিরিশের রাজু দে। মণ্ডপের ভিতরে দেখা যাবে বরফের স্তূপ, ঝর্না, ঝাড়বাতি। সিংহের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে জল। সিঙ্গাপুরের একটি হোটেলের আদলে তৈরি হচ্ছে গেট। উচ্চতা ৭৫ ফুট। বড় গেট থাকবে সাতটি। প্রতিমা কৃষ্ণনগরের। প্রকাশিত হচ্ছে ক্লাবের সাহিত্য স্মরণিকা ‘ঐকান্তিক’।
মতিগঞ্জ এগিয়ে চলো সঙ্ঘের পুজো এ বার ৪৮ বছরে পড়ল। হাওড়া ব্রিজের নীচে একটি জাহাজ আটকে গিয়েছিল কিছু দিন আগে। সেই বিষয়টিই এ বার পুজো উদ্যোক্তারা তুলে ধরেছেন থিমে। ১৮০ ফুট চওড়া জাহাজ তৈরি হচ্ছে। ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পাবেন দর্শকেরা। পুজোর দিনগুলিতে এখানে বাউল মেলা বসে। এ বার প্রায় শতাধিক বাউল আসবেন।পাইকপাড়া সবুজ সঙ্ঘের পুজো এ বার ৫১তম বর্ষের। গত বছর বড় মাপের পুজো করে উদ্যোক্তারা সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। এ বার মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে দক্ষিণ ভারতের একটি মন্দিরের আদলে।। নদীর এ পাড়ের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুজো হল জ্ঞানবিকাশিনী সঙ্ঘ, শান্তি সঙ্ঘ, কুঠিবাড়ি স্পোর্টিং ক্লাবের পুজো। শান্তি সঙ্ঘের পুজোয় দেবী দশপুজার পাশাপাশি দেখা যাবে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরকেও।
ইছামতীর অন্য পাড়ের পুজোগুলির মধ্যে প্রথমেই থাকবে ১২-র পল্লি স্পোর্টিং ক্লাবের পুজো। ক্লাবের ৩১তম বর্ষের পুজোতে মণ্ডপ তৈরি হয়েছে জয়পুরের একটি কৃষ্ণমন্দিরের আদলে। উচ্চতা, ৭০ ফুট। দুবাইয়ের হোটেল, বাবা লোকনাথ মন্দিরের আদলে তৈরি হয়েছে আলোর গেট।
অভিযান সঙ্ঘের পুজো এ বার ৭০ বছরের। সম্প্রতি ক্লাব সদস্য সুভাষ মুখোপাধ্যায় মারা যাওয়ায় এ বার জাঁকজমক কম হচ্ছে। পুজোর থিম, ‘আদিবাসী মানুষদের দৈনন্দিন জীবন-জীবিকা’। প্রতিমাও থিমের আদলে তৈরি হয়েছে। প্রকাশিত হচ্ছে ক্লাব-স্মরণিকা ‘অভিযান’।
গাঁধীপল্লি বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাব মণ্ডপ তৈরি করেছে হরিদ্বারের একটি কৃষ্ণমন্দিরের আদলে।
প্রতাপগড় স্পোর্টিং ক্লাবের থিম নেপালের ভূমিকম্প। আলোতে ফুটে তোলা হচ্ছে পাঁচটি দেশের সংস্কৃতি। পুজোর দিনগুলিতে এখানে মেলা বসে যায়। বলাকা সমিতি তাদের ৬৮ বছরে থিম করছে, ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’। প্রায় দু’হাজার সর্ষের তেলের টিন ও শতাধিক পিচের ড্রাম কেটে মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে। তৈরি হয়েছে ঠাকুরদানি। প্রতিটি ঠাকুরদানিতে থাকবে বিভিন্ন দেব-দেবতার মূর্তি। থাকছে চন্দননগরের আলো।
মুস্তাফিপাড়া যুবগোষ্ঠী তাদের ২৬তম বর্ষে থিম করেছে যমালয়। থাকছে জীবন্ত মডেল। রেটপাড়া স্পোর্টিং ক্লাবের থিম, বন্দে মাতরম। দেখানো হবে ‘স্বাধীনতার ভণ্ডামি’।
পূর্বপাড়া যুবকবৃন্দের মণ্ডপ তৈরি হয়েছে হাওড়া ব্রিজের আদলে। বিদ্যায়াতন ক্লাবের পুজোর থিম বাঁকুড়ার আদিবাসী গ্রাম। প্রফুল্লনগর সাংস্কৃতি চক্র ৬৭তম বর্ষে মণ্ডপ করেছে কৃষ্ণ মন্দিরের আদলে। বৈজয়ন্ত ক্লাবের মণ্ডপ তৈরি হয়েছে বিমানের আদলে।
এ ছাড়াও, চড়কতলা স্পোর্টিং ক্লাব, আমলাপাড়া অ্যাথলেটিক ক্লাব, প্রগতি সঙ্ঘ, ডায়মন্ড, ইয়ং বেঙ্গল, সুভাষনগর সেবা সমিতিও ভাল মানের পুজোর আয়োজন করেছে।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরুণ হালদার জানিয়েছেন, মানুষ যাতে ভাল করে প্রতিমা দর্শন করতে পারেন, সে জন্য সব রকম প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।