মাদক ছাড়াতে দিশা দেখাচ্ছে হারমোনি

ডায়েরিতে মা লিখে গিয়েছিলেন, ‘‘জীবনেও কি নেশা ছাড়তে পারবি না?’’ ছেলে তখন নেশার তাড়নায় সচ্ছল সংসার ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে ফুটপাথে। তিন বছর এমন কেটেছে। তারপর এক দিন নেশা থেকে মুক্তি পেয়েছে ছেলে। কিন্তু মা আর নেই। ডায়েরিতে মায়ের হাতের লেখাটুকু দেখে গুমরে ওঠে পিয়াল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাবদাতা

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৫ ০২:২১
Share:

ডায়েরিতে মা লিখে গিয়েছিলেন, ‘‘জীবনেও কি নেশা ছাড়তে পারবি না?’’ ছেলে তখন নেশার তাড়নায় সচ্ছল সংসার ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে ফুটপাথে। তিন বছর এমন কেটেছে। তারপর এক দিন নেশা থেকে মুক্তি পেয়েছে ছেলে। কিন্তু মা আর নেই। ডায়েরিতে মায়ের হাতের লেখাটুকু দেখে গুমরে ওঠে পিয়াল।

Advertisement

কিন্তু কী করে ছাড়ল মাদকের নেশা? পারল তারই মতো অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের সাহায্যে। হাবরার তাদের দলটির নাম ‘হারমোনি গ্রুপ।’ কোনও নথিভূক্ত এনজিও বা সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। এ কেবল তাদের দেখা করা, কথাবার্তা, পরস্পরকে সহায়তার মঞ্চ। বিদেশে ‘অনামা মদাসক্ত’ এবং ‘অজানা মাদকাসক্ত’ গ্রুপগুলি যেভাবে চলে, প্রাক্তন মাদকাসক্তরাই নেশাগ্রস্তদের সাহস জোগায়, ধৈর্য জোগায় সেই ভাবধারা নিয়ে হারমোনি সমাজে ফিরিয়ে দিয়েছে পিয়ালের মতো বহু ছেলেমেয়েকে।

কী করে কাজ করেন ‘হারমোনি’-র সদস্যরা? প্রতিদিন সন্ধ্যায় এক ঘণ্টার জন্য হাবরার হিজলপুকুরের পাত্র প্যালেসে জড়ো হন সবাই। শুধু সেই দিনটা যে তারা নেশা করেননি, এবং ২৩ ঘণ্টা যে নেশা করবেন না, এটুকুই একে অন্যকে জানান দেন সদস্যরা। সারা দিন অন্যদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছেন, জানিয়ে তৃপ্তি পান কেউ। আবার অন্যের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার জন্য দুঃখপ্রকাশও করেন অনেকে।

Advertisement

আজ, শুক্রবার বিশ্ব মাদকবিরোধী দিবস। উত্তর ২৪ পরগনা জেলাশাসক মনমীত কৌর নন্দা বলেন, ‘‘মাদক বিরোধী দিবসে অনেক অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু আমাদের দেশের যুব সম্প্রদায়ের যে কতটা ইতিবাচক শক্তি রয়েছে, হারমোনি গ্রুপের কাজ তার প্রমাণ।’’

অনেকটা শক্তি না থাকলে কি জীবনের মোড় ঘোরানো যায়? এই ছেলেমেয়েদের মধ্যে বসলে শোনা যায় একের পর এক গল্প, যেখানে অতল খাদে মিলিয়ে যাওয়ার মুখ থেকে ফের সমাজ-সংসারে ফিরে এসেছে তরুণেরা। একটি ছেলের গল্প এই রকম। বাবা-মায়ের মধ্যে ছিল অশান্তি। অবহেলা আর একাকিত্ব থেকে অষ্টম শ্রেণি থেকে ছেলেটি শুরু করে মদ্যপান। এরপরে একে একে ড্রেনডাইট, গাঁজা এবং সবশেষে মাদক ইনজেকশন, নানা নেশায় জড়িয়ে পড়ে সে। টাকার জোগানের জন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশের হাতে তিনবার ধরা পড়ে, তবে অল্প বয়সের জন্য ছাড় পেয়ে যায়। বাড়িতে জোর করে আটকে রাখলে নিজের হাত-পা কেটে শুরু করত নিজের উপর অত্যাচার। মাস দুয়েক পুনর্বাসন কেন্দ্রে কাটিয়ে হারমনি গ্রুপের সদস্য হয় সে। তারপর কেটে গিয়েছে দু’বছর। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। তার কথায়, ‘‘যারা নেশাগ্রস্ত, আমার ঘটনাটা তাদের জানা দরকার।’’

হাবরার সমাজবিরোধী, এক নম্বরের নেশাখোর বলতে এক ডাকেই সবাই চিনত টুকটুক নামে ছেলেটিকে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া এই সব এলাকায় হেরোইন পাচারের বাড়বাড়ন্ত বরাবরই। তাই হেরোইনের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত টুকটুক। তিতিবিরক্ত বাড়ির লোকেরা টাকা দিয়ে দশ বছর বিভিন্ন পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠিয়ে আটকে রাখে তাকে। তার পর খোঁজ মেলে হারমোনি-র। এই সংস্থার হাত ধরার পর আর কোনও রকম নেশা ছুঁয়েও দেখেনি টুকটুক। এখন পারিবারিক ব্যবসা দেখছে সে।

সংস্থার সদস্য পিনাকী কর জানান, ‘‘প্রথমে সমাজ থেকে, পরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকীত্বে ভুগতে থাকেন নেশাগ্রস্তরা। এখানে এসে তাঁরা মনে বল পান।’’ সেই কথাই বলল শৌভিক। দিনকয়েক আগে তাকে সংস্থায় নিয়ে আসে এক সদস্য। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শৌভিক বলে, ‘‘এখন আর না এসে পারি না। সংস্থায় প্রথমে ঢুকেই সবাইকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করতে হয়। আমার চেয়েও বয়স্ক, মেধাবি, মানুষ যখন বুকে নিয়ে ভরসা দেয়, তখন মনের জোরটা বেড়ে যায়।’’ বাড়ির লোকের সহায়তাও দরকার হয়। তাই বাড়ির লোকেদের সঙ্গে বৈঠকও করা হয়, জানালেন পিনাকী। একা নেশা করার থেকে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নেশা করতে ভাল লাগে। নেশা ছাড়ার ক্ষেত্রেও সেটা অনেকটাই ঠিক, জানালেন সংস্থার সদস্য সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। তাই সংস্থার অন্যতম স্লোগান, ‘টুগেদার উই ক্যান।’ অর্থাৎ, সবাই মিলে একসঙ্গে নেশা ছাড়তে পারব। কাজটা সহজ নয়। অনেকে মাঝেমধ্যে ফের শুরু করে দেয় নেশা। দলের বন্ধুরা ফের পাশে দাঁড়ায়। ভরসা দেয়, ‘‘কিস্যু হয়নি। চল্, আমরা তো আছি।’’

সাড়ে চার বছরের উপর হয়ে গেল, এক ফোঁটা মদ ছুঁয়ে দেখেননি অশোকনগরের বাসিন্দা মধ্যচল্লিশের পিয়াল। একসময় মা অনেক বারণ করেছিলেন। ডায়েরিতে লিখেও যান, ছেলে নেশা ছাড়তে না পারায় তাঁর আক্ষেপের কথা। মা এখন আর নেই। সেই ডায়েরি দেখিয়ে চিৎকার করে ওঠেন পিয়াল। ‘‘মা, একবার দেখো, আমি পেরেছি।’’ দলের বন্ধুরা তখন বুকে জড়িয়ে ধরে পিয়ালকে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement