ইভিএম ভেঙে চেপে ধরল আমার কলার

সরকারি চাকরি করলে ভোটের কাজে যেতেই হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করার সুবাদে ভোটের দায়িত্ব আমার কাছে নতুন নয়। এ রাজ্যে প্রায় ১২টি ভোটে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করে ফেলেছি। কিন্তু নয়া জমানায় ২৫শে এপ্রিল টাকিতে ভোট করাতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হল, তেমনটা এর আগে কোনও দিন হয়নি।

Advertisement

অজয়রঞ্জন শিকদার (ভোটের প্রিসাইডিং অফিসার)

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪৮
Share:

সরকারি চাকরি করলে ভোটের কাজে যেতেই হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করার সুবাদে ভোটের দায়িত্ব আমার কাছে নতুন নয়। এ রাজ্যে প্রায় ১২টি ভোটে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করে ফেলেছি। কিন্তু নয়া জমানায় ২৫শে এপ্রিল টাকিতে ভোট করাতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হল, তেমনটা এর আগে কোনও দিন হয়নি।

Advertisement

আমার ডিউটি ছিল টাকির ভবনাথ ফ্রি-প্রাইমারি স্কুলে। টাকি পুরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ৬ ও ৭ নম্বর বুথ ওই স্কুলবাড়িতে। আমি ছিলাম ৬ নম্বর বুথের দায়িত্বে। শুক্রবার রাতেই আমরা, ভোটকর্মীরা ওখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। ভোটের সব আয়োজন ভাল ভাবেই সারা হয়েছিল।

শনিবার সকাল সাতটা থেকে ভোট শুরু হওয়ার কথা। ঠিক সময়েই শুরু হল। স্কুলের একটি ঘরেই ভোট নেওয়া হচ্ছে। ত্রিপল দিয়ে দু’টি বুথকে আলাদা করে নিয়েছিলাম আমরা। আমরা মানে, আমি আর তিন জন পোলিং অফিসার। চারটি বড় দলের এজেন্টরাও এসে গিয়েছিলেন। ঘরের বাইরে পাহারায় ছিলেন দুই পুলিশ কর্মী। এক জনের হাতে বন্দুক, অন্য জনের হাতে লাঠি।

Advertisement

ভালই ভোট হচ্ছিল। ৬ নম্বর বুথে মোট ১০২৫ জন ভোটার থাকার কথা। ভোটাররা দিব্যি লাইন দিয়ে ভোট দিচ্ছিলেন। দলীয় এজেন্টরাও যথেষ্ট সহযোগিতা করছিলেন। ১৮ এপ্রিল কলকাতার ভোটে বেশ গণ্ডগোল হয়েছিল বলে সংবাদমাধ্যমে জেনেছিলাম। ২৫ তারিখ কী হয়, তা নিয়ে মনে একটু দুশ্চিন্তা ছিল বই কী! কিন্তু শনিবার সকাল থেকে আমাদের বুথের পরিবেশ এতই ভাল ছিল যে, উদ্বেগের কথা আর মাথায় থাকেনি।

আবহাওয়াটা এক নিমেষে পাল্টে গেল বেলা বাড়ার পরে। ঘড়িতে তখন পৌনে বারোটা হবে। বেশ মনে আছে, তখনও অবধি প্রায় ৪৯৩টা ভোট পড়েছে। বুথের বাইরে ভোটারদের লাইনও আছে। তাঁদের ধাক্কা মারতে মারতে হঠাৎ বুথে চড়াও হল জনা চল্লিশের একটা দল। ভয়ে এদিক ওদিক দৌড়তে শুরু করলেন ভোটাররা। কী হচ্ছে বোঝার আগেই ত্রিপলগুলো টান মেরে ছিঁড়তে শুরু করল গুন্ডারা। মুখে অশ্রাব্য গালিগালাজ। আর, একটাই হুঙ্কার, ‘‘ভোট দিতে দেব না!’’

আমি প্রথমে কিছুটা থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। তার পর কোনও রকমে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ইভিএম মেশিনটা বন্ধ করে দিলাম। তখনই ওই দলের কয়েক জন এগিয়ে এসে ইভিএম তুলে আছাড় মারতে শুরু করল। আমি তখন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমার সামনেই তাণ্ডব চালাচ্ছে ওরা। কী করে আটকাব, বুঝতে পারছি না। চোখ পড়ল বুথের দরজার বাইরে থাকা দুই পুলিশ কর্মীর দিকে। তাঁরাও দেখি, আতঙ্কে নড়বড় করছেন। তবু ওঁদের দেখেই মনে খানিক সাহস আনলাম। ঢোক গিলে ওদের বললাম, ‘‘এ সব কী হচ্ছে?’’

যেই না বলা, গোটা দলটা তেড়ে এল আমার দিকে। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি মুহূর্তের মধ্যে দুই পুলিশ কর্মী উধাও। ধাক্কাধাক্কির মধ্যে বুথের ভিতরে অন্য পোলিং অফিসার আর পোলিং এজেন্টরা কে কোথায় ছিটকে গিয়েছেন, তা-ও খেয়াল করিনি। আমার পা কাঁপতে শুরু করেছে। বহিরাগত ওদের সামনে আমি বলতে গেলে একাই। এক জন এগিয়ে এসে আমার জামার কলার ধরল। ব্যস! আর কিছুই বলার সুযোগ পেলাম না। আমাকে ঘিরে ধরে বেধড়ক মারতে শুরু করল ওরা। এক সময়ে বুঝতে পারলাম, মারতে মারতে আমায় মেঝেতে ফেলে দিয়েছে। চিৎকার করছি, বারবার জানতে চাইছি, আমার অপরাধ কী? গালিগালাজ ছাড়া কোনও উত্তর পাইনি। এক নাগাড়ে কিল-ঘুঁষি-লাথি এসে পড়ছে আমার উপরে। এত মার জীবনে আর কখনও খাইনি। কী করে বাঁচব, আদৌ বাঁচব কি না, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বোঝার মতো ক্ষমতাও ছিল না। কিছু ক্ষণ পরে কেউ একজন ওদের থামাল। তিনি কে, দেখতে পাইনি। মেঝেতে পড়ে যখন গোঙাচ্ছি, আশপাশে কেউ ছিল না। খানিক ক্ষণ কোনও মতে একাই উঠে বসলাম। দেখলাম গুন্ডারা চলে গিয়েছে। গোটা বুথটা একেবারে তছনছ হয়ে গিয়েছে।

আমার জামার খানিকটা অংশ লাল হয়ে ভিজে রয়েছে। বুঝলাম, মাথা ফেটে গিয়েছে আমার। সেই রক্ত এসে পড়েছে জামায়। মুখ-নাক ফোলা। প্রচণ্ড ব্যথা। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। উঠে হেঁটে বাইরে বেরনোর চেষ্টা করব? বেরোলে যদি ওরা আবার মারে? এমন সময় বেশ কয়েক জন যুবক দৌড়ে ঘরের ভিতরে ঢুকল। আমার তখন মাথা ঘুরছে। ভাবছি, আবার মার খেলে আর প্রাণে বাঁচব না। কিন্তু না, ওই যুবক আমাকে মারতে আসেনি। আমাকে বাঁচাতে এসেছিল। আমার কাছে এসে বলল ‘‘আপনাকে তো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে!’’ ওই ছেলেটি আর তার বন্ধুরাই একটি স্কুটি করে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। হাসপাতাল থেকে যখন ফিরলাম, তখন দেখলাম স্কুলবাড়ির চারপাশে বন্দুকধারী অনেক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। ঘটনাস্থলে চলে এসেছেন প্রশাসনের বড় কর্তারাও। ভিড়ের মধ্যে খোঁজার চেষ্টা করলাম, ওই দু’জন পুলিশকর্মীকে! যাঁরা থরথর করে কাঁপছিলেন! কিন্তু তাঁদের আর দেখতে পাইনি। সোমবারও আমি অফিসে যেতে পারিনি। চিকিৎসক বাড়িতে বিশ্রাম নিতে বলেছেন। আমি অফিসে জানিয়েছি, আমাকে যেন আর ভোট দিতে যেতে না হয়। একান্তই যেতে হলেও সঙ্গে এক জন নিরপত্তারক্ষী দিয়ে যেন পাঠানো হয়। ভাবতে অবাক লাগছে, গণতন্ত্রের একটি প্রক্রিয়ায় সামিল হতে গিয়ে এক জন ভোটকর্মীকে এতটা বিপদের মধ্যে পড়তে হল?! আমার, আমাদের নিরাপত্তার কোনও দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন বা রাজ্য সরকার বা পুলিশ প্রশাসন কেউ নেবে না? আমাদেরও তো পরিবার রয়েছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন