প্রশিক্ষণ: স্কুলে ‘হাইমলিখ কৌশল’ শেখাচ্ছেন সৌম্য। —নিজস্ব চিত্র
ক’দিন আগের অঘটনের কথা ভাবলে এখনও হাত কামড়ান গ্রাম বাংলার তরুণ শিক্ষক।
হাসপাতালে না-দেখিয়ে বাড়িতে সহজ কসরতেই বাঁচতে পারত চার বছরের ছেলেটা। গলায় বাদাম আটকে তার ছটফটানির সময়ে কী করবেন বুঝে উঠতে পারেননি মা-বাবা। অথচ ছেলেটার পেটে সঠিক ভাবে চাপ দিলেই ফুসফুসের হাওয়ার পাল্টা ধাক্কায় শ্বাসনালির মুখ খুলে যেত!
গলায় খাবার ঢুকে শ্বাস আটকে গেলে এটাই সর্বজনীন জীবনদায়ী চিকিৎসা। বিখ্যাত মার্কিন থোরাসিক সার্জেন হেনরি হাইমলিখ-এর নামে যার নাম ‘হাইমলিখ কৌশল’। বেশ কিছু দিন ধরে স্কুলে স্কুলে ঘুরে এটাই শেখাচ্ছেন সৌম্য সেনগুপ্ত। বাঁকুড়া বিষ্ণুপুরের কাছে রাধানগর বোর্ড প্রাথমিক স্কুলের মাস্টারমশাই তিনি। সেই সঙ্গে গণস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীও, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির স্বেচ্ছাসেবী।
সম্প্রতি বিষ্ণুপুরেই গলায় বাদাম আটকে মারা গিয়েছে আয়ুষ অধিকারী। বছর তিনেক আগে বারাসতের একটি দশ মাসের শিশু বা নিউটাউনের নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির আরিয়ান দত্তও গলায় খাবার আটকে মারা যায়। ‘চোকিং’য়ের এই সব ঘটনায় কখনও হাসপাতাল, কখনও স্কুলের দিকে আঙুল উঠেছে। অথচ একটু সচেতন হলেই এ মৃত্যু আটকানো যায়।
হাইমলিখ কৌশল
শ্বাসনালিতে খাবার আটকে গেলে পেটে নাভির কাছে চাপ দিন। ফুসফুসের হাওয়ার ধাক্কায় শ্বাসনালির মুখ খুলে যাবে। জীবন বাঁচবে। যা করার চার মিনিটের মধ্যে করতে হবে।
বছর চারেক আগে নিজের স্কুলে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র শীতল লোহারকে ‘হাইমলিখ কৌশলে’ বাঁচিয়েছিলেন সৌম্য। তারপরই বিষয়টা নিয়ে মাঠে নেমেছেন তিনি। বাঁকুড়ার স্কুলগুলিতে ঘুরে ঘুরে প্রচার চালাচ্ছেন। তা ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া তো আছেই। সেখানেও নিয়মিত ভিডিও পোস্ট করছেন। জরুরি শিক্ষা ভূগোলের বেড়া ডিঙিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে সর্বত্র।
সৌম্যরা শেখাচ্ছেন, কিছু আটকালে গলায় হাত দিয়ে ইশারায় বোঝানোটা খুব দরকার। ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম, হাইমলিখ সঙ্কেত। তার পরের কাজটা কঠিন নয়। কাগজ ঠেসে বন্ধ-মুখ প্লাস্টিক বোতলের পেট টিপে সৌম্য দেখাচ্ছেন, ভিতরের হাওয়ার ঠেলা কী ভাবে কাগজটা ছুড়ে ফেলছে। বা নাভিমণ্ডলে চাপ দিয়ে দেখাচ্ছেন কী করে ফুসফুসের হাওয়া শ্বাসনালিতে ঢোকা খাবার ঠেলে বের করে দেয়। একা থাকলে নিজের পেটে চেয়ার গোছের কিছু চেপে ধরেও এটা চেষ্টা করা যায়। তবে হাতে সময় মিনিট চারেক। কারণ শ্বাসনালির মুখ আটকে গেলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন ঢোকে না। তাতে মৃত্যু অনিবার্য। এ দেশের প্রথম এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ ভাবেই জাপানে গলায় মাংসের হাড় আটকে মারা গিয়েছিলেন।
গণস্বাস্থ্য আন্দোলনের দীর্ঘদিনের কর্মী, চিকিৎসক পুণ্যব্রত গুণ বলছেন, ‘চোকিং’ ঠেকাতে ‘হাইমলিখ কৌশল’ স্কুলের সিলেবাসেও থাকা উচিত। স্কুলের নিচু ক্লাসে এখন
‘সিপিআর’ বা হৃৎশ্বাস পুনরুজ্জীবন শেখানো হয়। নাড়ি বা বুকের ধুকপুক থেমে গেলে মিনিটে ১০০ বার চাপ দিয়ে বা দরকারে মুখে মুখ দিয়ে হাওয়া ঢুকিয়ে রোগীকে বাঁচানোর এটাই প্রাথমিক চিকিৎসা। প্রাথমিক চিকিৎসার নানা দিকের মতো ‘হাইমলিখ কৌশলে’র গুরুত্ব মানছেন রাজ্য সিলেবাস কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদারও। বিষয়টি সিলেবাসে ঢুকতে পারে বলে আশ্বাস দিচ্ছেন তিনি।