শহর হোক বা মফস্সল, কিছু কিছু স্কুলে পৌঁছে গিয়েছে কম্পিউটার। কোথাও কোথাও ব্ল্যাকবোর্ডের বদলে বসেছে প্রজেক্টর। চকের লেখার বদলে স্ক্রিনে ফুটে উঠছে ‘অডিও ভিস্যুয়াল’ ঐতিহাসিক যুদ্ধ বা মানবদেহ গঠনের বৃত্তান্ত। ‘ই-লার্নিং’-এর ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এ রাজ্যেও শুরু হয়ে গিয়েছে ‘স্মার্ট ক্লাসরুম’।
কিন্তু এই সব কতটা সফল, প্রশ্ন তুলে দিল ইউনিসেফের সাম্প্রতিক রিপোর্ট। সম্প্রতি কলকাতায় ‘দ্য স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস চিলড্রেন ২০১৭’ নামে ওই রিপোর্ট বলছে, বিশ্বে মাত্র ৩০ শতাংশ শিশু ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায়। অর্থাৎ ৭০ শতাংশ শিশুই এখনও ই-সরস্বতীর প্রসাদ থেকে বঞ্চিত। এবং এই রাজ্যও তার ব্যতিক্রম নয়।
ইউনিসেফের এ রাজ্যের মুখ্য অফিসার মহম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘‘বিশাল তথ্যভাণ্ডার ব্যবহারের সুযোগ এখনও অধিকাংশ শিশুর কাছেই নেই। এই বৈষম্য মেটানো জরুরি।’’ ভারত-সহ ২৩টি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে তৈরি ইউনিসেফের ওই রিপোর্ট প্রকাশের পরেই বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে শিক্ষা মহলে। তা হলে কি ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার পদ্ধতিতে কোথাও গলদ থেকে যাচ্ছে? স্কুলশিক্ষা দফতরের একাংশ নিজেদের কিছু দুর্বলতার কথা ইতিমধ্যেই স্বীকার করে নিয়েছেন।
দফতরের এক কর্তা জানান, ই-লার্নিং নিয়ে বহু প্রকল্পের কাজ চলছে। দেখাশোনা করছে সর্বশিক্ষা মিশন। প্রথমে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও কম্পিউটার শিক্ষক এবং পরে অন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পঠনপাঠনে ইন্টারনেটের ব্যবহারের পাশাপাশি সকলের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের অভ্যাস তৈরি করতে চাইছে সরকার। কিন্তু এই উদ্যোগ যে অনেক ক্ষেত্রেই হোঁচট খাচ্ছে।
শিক্ষা সূত্রের খবর, এ রাজ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ১৫ হাজার স্কুল রয়েছে। তার প্রায় প্রতিটিতেই কম্পিউটার পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু গ্রামের দিকে ইন্টারনেট সংযোগ খুব দুর্বল। ফলে স্কুলে কম্পিউটার থাকলেও পড়ুয়ারা তা ঠিকমতো ব্যবহারই করতে পারে না। অর্থাভাবে প্রায় অর্ধেক স্কুলে ‘প্রজেক্টর’ পাঠানো যায়নি। প্রজেক্টর বা বড় স্ক্রিন না-থাকলে ওই কম্পিউটারের মাধ্যমে পুরো ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো সম্ভব নয়।
রাজ্যে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। তার মধ্যে মাত্র ৬৫০টিতে কম্পিউটার পৌঁছে দেওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ ছোট থেকেই ইন্টারনেট ব্যাবহারের যে-ধারণা গড়ে তোলা দরকার, সেটাই তৈরি করা যায়নি। অন্যান্য রাজ্য এবং এ রাজ্যের বেসরকারি স্কুলে ই-লার্নিংয়ের ধারণা অনেক আগে শুরু হলেও সরকারি পোষিত ও সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলিতে তা শুরু হয়েছে ২০১৩-’১৪ শিক্ষাবর্ষে। তাই পড়ুয়াদের কাছে সেটা পৌঁছতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে বলেই স্কুলশিক্ষা দফতরের অভিমত। অনলাইন গেম নিয়ে কর্মশালা করে অভিভাবকদের সচেতন করার কাজ চলছে। ইন্টারনেটের ব্যবহার নিয়েও বিভিন্ন জেলায় কর্মশালা শুরু হয়েছে।
ডিজিটাল মাধ্যমকে ব্যবহার করে পঠনপাঠন সংক্রান্ত নানান তথ্যের আদানপ্রদান শেখানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক বিষয়েও শিশুদের সচেতন করা হচ্ছে। যেমন মালদহের একটি স্কুলের পড়ুয়া স্বাতী দাস জানাল, এলাকায় নাবালিকা বিবাহের খবর পেলে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেই পড়ুয়ারা ছবি এবং ভিডিও স্থানীয় প্রশাসনকে পাঠায়। ফলে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে পারে।
রাজ্য শিশুর অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘শিশুদের একটা বড় অংশ ডিজিটাল সুবিধার সীমানার বাইরে। তাদের এই বৃত্তের মধ্যে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল সুবিধার যথাযথ ব্যবহার শেখানোর দিকেও নজর দিতে হবে।’’ রাজ্য সরকার ডিজিটাল-সাক্ষরতা নিয়ে নানা ধরনের পরিকল্পনা করেছে, জানাচ্ছেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা।