মহারাষ্ট্র পেরেছে। তার আগে দিল্লি, অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্য পেরেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এখনও পেরে উঠল না।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি) বলছে, মহিলাদের উপরে অ্যাসিড হামলার ঘটনা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উত্তরপ্রদেশে। তার পরেই পশ্চিমবঙ্গ। মহারাষ্ট্রের স্থান নবম। তার রাজধানী শহরে প্রীতি রাঠি নামে দিল্লির এক নার্সের উপরে অ্যাসিড হামলা এবং তাঁকে খুনের ঘটনাকে ‘বিরল থেকে বিরলতম’ চিহ্নিত করে বৃহস্পতিবার মুম্বইয়ের বিশেষ মহিলা আদালত দোষী অঙ্কুরলাল পানোয়ারের ফাঁসির সাজা ঘোষণা করেছে। গত পাঁচ বছরে এ রাজ্যে অ্যাসিড হামলার ঘটনা বেলাগাম ভাবে বেড়ে হয়েছে ১২৫টি। আক্রান্তদের কারও মৃত্যু হয়নি ঠিকই, কিন্তু অঙ্গহানি হয়েছে। মাত্র কয়েক জন সরকারি ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। অথচ, সাজা হয়নি কোনও অভিযুক্তের!
ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩২৬এ (অ্যাসিড এবং ওই জাতীয় দাহ্য ছোড়া) এবং ৩২৬বি (অ্যাসিড বা ওই জাতীয় দাহ্য ছোড়ার চেষ্টা) ধারায় অভিযুক্তের ন্যূনতম সাত বছর এবং সর্বাধিক দশ বছর জেল হতে পারে। দু’টি ধারাই জামিনঅযোগ্য। তাই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, এখানে কেন অ্যাসিড হামলায় অভিযুক্তদের সাজা হয় না? কেন তারা সহজে জামিন পেয়ে যায়? এর পিছনে মূলত পুলিশের উদাসীনতাকেই দুষছে অ্যাসিড-আক্রান্তদের জন্য কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা এবং সংগঠন। পাঁচ বছর আগেও কোনও অ্যাসিড হামলায় এ রাজ্যে কারও সাজা হয়েছে বলে মনে করতে পারছে না তারা। তা ছাড়া, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশমতো কারা দোকানে অ্যাসিড রাখছেন, কারা কিনছেন বা তাঁদের পরিচয়পত্র জমা নেওয়া হচ্ছে কি না— এ সব নজরদারিও পুলিশ ঠিকমতো করে না বলে অভিযোগ।
এ রাজ্যে মহিলা আদালত ধুঁকছে পরিকাঠামোর অভাবে। অন্য আদালতেই এ জাতীয় মামলার শুনানি হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘পুলিশ অন্য অনেক মামলার মতো অ্যাসিড হামলাকেও সাধারণ চোখে দেখে। ফলে চার্জশিটও জমা পড়ে দেরিতে, আবার কোথাও পড়ে না। একটা সময়ের পর অভিযুক্ত জামিন পেয়ে যায়।’’ একই সঙ্গে তিনি মনে করেন, ‘‘বিচার ব্যবস্থারও উচিত পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ করানো। কিন্তু সেটা হয় না।’’ দেশের অ্যাসিড আক্রান্তদের সংগঠন, ‘অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন’ (এএসএফআই)-এর বিক্রমজিৎ সেনও পুলিশের দীর্ঘসূত্রিতাকেই দুষেছেন। কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার বলেন, ‘‘আমার সময়ে এত অ্যাসিড হামলা হতো না। অ্যাসিড হামলা খুনের চেয়ে কোনও অংশে কম অপরাধ নয়। যদি সত্যিই পুলিশ ঘটনাগুলিকে গুরুত্ব সহকারে না দেখে, তা হলে প্রাক্তন পুলিশকর্তা হিসেবে আমি লজ্জিত।’’
পুলিশের এই ‘উদাসীন মানসিকতা’ খুব অস্বাভাবিক নয় বলেই মনে করেন মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল। তাঁর কথায়, ‘‘অ্যাসিড-আক্রান্তদের দেখে প্রাথমিক ভাবে বীভৎসতা বোঝা যায় না। কারণ, পোড়া জায়গাটুকুতে প্রথম দিকে কালো দাগ ছাড়া কিছুই বোঝা যায় না। তাই মনে হয় পুলিশ প্রাথমিক ভাবে ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারে না। মামলাগুলিকে আর পাঁচটা সাধারণ মামলার মতো ধরে তদন্তে গড়িমসি করে।’’
কোনও অভিযোগ মানতে চাননি রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা। তাঁর দাবি, ‘‘অ্যাসিড হামলার মামলা গুরুত্ব দিয়েই দেখা হয়। কিন্তু যদি গুরুত্ব দেওয়া না হয়, আক্রান্তেরা নির্দিষ্ট ভাবে অভিযোগ জানালে দৃঢ় পদক্ষেপ করা হবে।’’
গত পাঁচ বছরে রাজ্যে অ্যাসিড হামলার ঘটনায় মাত্র এক অভিযুক্ত জেল-হাজতে রয়েছে। বাকিরা জামিনে মুক্ত। আক্রান্তদের অধিকাংশই এখনও চিকিৎসাধীন। যেমন, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের কলেজ ছাত্রীর উপরে অ্যাসিড হামলা হয়েছিল গত বছর ৯ মে। অভিযুক্ত তিন মাস হাজতবাসের পরে জামিন পায়। অথচ, ছাত্রীটি এখনও কলকাতায় সপরিবার লুকিয়ে থেকে চিকিৎসা করিয়ে চলেছেন। দাসপুরে গেলেই তাঁকে হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে বলেও অভিযোগ। এমন উদাহরণ আরও রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো আক্রান্তেরা সব ক্ষেত্রে হাসপাতালে নিখরচায় চিকিৎসা পাচ্ছেন না— এই অভিযোগ তো রয়েছেই, পাঁচ বছরে সরকারি তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ মাত্র সাত-আট জন পেয়েছেন বলে দাবি এএসএইআইয়ের। প্রশাসনের কর্তাদের পাল্টা দাবি, আক্রান্তদের পরিবারের পক্ষ থেকে যথাযথ কাগজপত্র সময়মতো দেওয়া হয় না বলেই ক্ষতিপূরণ দিতে দেরি হয়।
কিন্তু বিচারটুকুও যদি না পান, তা হলে তাঁরা কোথায় যাবেন? ক্ষোভ অনেক আক্রান্তের পরিবারেরই।