শুকিয়ে যাওয়া ধানগাছ গোরুকে খাওয়াতে কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।
পুরুলিয়া জেলার অধিকাংশ কৃষি মৌজাকে খরা ঘোষণা করল রাজ্য সরকার।
সম্প্রতি রাজ্যের কৃষি দফতর থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই জেলার ২০টি ব্লকের সর্বশেষ তথ্য ও পরিস্থিতি সরজমিনে দেখে জেলার ২৬৭১টি মৌজাকেই খরা বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু গত অগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে গোটা জেলা জুড়ে বৃষ্টি না হওয়ায় মাঠে জ্বলে গিয়েছে ধানগাছ। তার পরেও খরা ঘোষণা করতে কেন এতদিন অপেক্ষা করল রাজ্য সরকার তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন চাষিদের একাংশ। যদিও কৃষি বিশেষজ্ঞদের দাবি, বরাবর সেপ্টেম্বর মাসে বৃষ্টি হয়। তাই সেই বৃষ্টিতে ধান রক্ষার আশায় ছিলেন তাঁরা। তা ছাড়া তাড়াহুড়ো করে খরা ঘোষণা করা হলে, অনেক এলাকা বাদ পড়ে যেত। তাই সময় নিয়ে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করেই খরা ঘোষণা করা হয়েছে। রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু বলেন, ‘‘পুরুলিয়ায় অনাবৃষ্টিজনিত পরিস্থিতিতে এ বার আমন চাষ মার খেয়েছে। তাই সব রকম খতিয়ে দেখে খরা ঘোষণা করা হয়েছে। চাষিদের জন্য সরকার যা করার তা করবে।’’
জেলা কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলায় আমন চাষ যোগ্য জমির পরিমাণ ২,৭২,২২২ হেক্টর। এ বার জুলাই মাসে (৫২৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়) পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় ২,৬৬,৬২১ হেক্টর জমিতে ধানবীজ রোয়া-পোঁতার কাজ হয়। কিন্তু অগস্টের মাঝামাঝি থেকে পুরুলিয়ার আকাশ মেঘশূন্য থেকে গিয়েছে। এই জেলায় অগস্ট মাসের গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেখানে ২৮২ মিলিমিটার, সেখানে এ বছর বৃষ্টি হয়েছে ২০১ মিলিমিটার। সাধারণত সেপ্টেম্বর মাসের বৃষ্টিতেই ধানের শিষে দুধ আসে। অর্থাৎ এই সময়েই চাল তৈরি হয়। কিন্তু সেপ্টেম্বরে জেলার গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২১২ মিলিমিটার হলেও এ বার বৃষ্টি হয়েছে মোটে ৬৭.৩ মিলিমিটার। অর্থাৎ ৬৮ শতাংশ কম। আর অক্টোবরে গড় বৃষ্টির পরিমাণ ৮৫ মিলিমিটার হলেও এই মাসে জেলা বৃষ্টি পেয়েছে মাত্র ২৩ মিলিমিটার।
অগস্ট থেকেই বৃষ্টি কমতে থাকায় চলতি বছরে কৃষি দফতরের হিসেব মোতাবেক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১,৮২,৮৭৮ হেক্টর জমির ধান। কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু পুজোর পরে ওই রিপোর্ট পেয়ে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে জেলার চাষের পরিস্থিতি সরজমিনে দেখতে আসেন। পরিদর্শনে বেড়িয়ে তিনি দেখেন, চাষিরা গরুকে খাওয়ানোর জন্য শুকনো ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছেন।
কৃষি দফতর সূত্রের খবর, সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে সাঁতুড়ি ব্লকে। এই ব্লকে ক্ষতির পরিমাণ ৮২.৮৩ শতাংশ। রঘুনাথপুর ১ ব্লকে ৮০.৬৩ শতাংশ, মানবাজার ২ ব্লকে ৭৯.৯২ শতাংশ, রঘুনাথপুর ২ ব্লকে ৭৮.০২ শতাংশ, হুড়া ব্লকে ৭৭.৩২ শতাংশ, মানবাজার ১ ব্লকে ৭২.২৯ শতাংশ, পাড়াতে ৭২.৬৯ শতাংশ, কাশীপুরে ৬৮.৫১ শতাংশ, পুঞ্চাতে ৬৯.৩৩ শতাংশ, ঝালদা ২ ব্লকে ৭২ শতাংশ, বলরামপুরে ৬৮ শতাংশ, বান্দোয়ানে ৬৯.৯১ শতাংশ-সহ প্রায় সমস্ত ব্লকেই ক্ষতি হয়েছে। গড়ে জেলায় ক্ষতির পরিমাণ ৬৮.৫৯ শতাংশ।
কিন্তু ধানগাছ শুকোচ্ছিল সেই সেপ্টেম্বর থেকেই। তখনই জলের সমস্যা শুরু হয়। কিন্তু কৃষি দফতরের সক্রিয় হতে এতদিন কেন লাগল? প্রশ্ন তুলেছেন অনেক চাষিই। যেমন আড়শার নুনিয়া গ্রামের শান্তিরাম মাহাতো, আহাড়রা গ্রামের দেবেন্দ্রনাথ মাহাতোদের কথায়, ‘‘আগে খরা ঘোষণা করা হলে যেটুকু পুকুরের জল ছিল তা খরার সাহায্যার্থে পাওয়া বিকল্প চাষের জন্য বাঁচাতে পারতাম। সেই জলে খেসারি কিংবা ছোলা চাষের মতো ডালশস্য চাষ করতে পারতাম। কিন্তু ধান বাঁচাতে পুকুরের অবশিষ্ট জলটুকুও শেষ করে ফেলেছি।’’ যদিও কৃষি বিশেষজ্ঞদের দাবি, আগে অল্পজমিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পরে ক্ষতির ব্যাপকতা বেড়েছে। আগে খরা ঘোষণা করা হলে কম লোক সুবিধা পেতেন। পরে আরও এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তখন বিভ্রান্তি বাড়ত। তাঁদের মতে, ঠিক সময়েই খরা ঘোষণা করা হয়েছে। জেলায় মোট কৃষি মৌজা হল ২৬৯০। তার মধ্যে ২৬৭১টি মৌজাকেই খরা বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে এর ব্যাপকতা অনেক।
এ দিকে, খরা ঘোষণার পরে জেলা প্রশাসন রাজ্য সরকারের কাছে কয়েক দফা প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তার একটি হল মাওবাদী উপদ্রুত এলাকার মতোই জেলার বাকি ব্লকগুলিতে দু’টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া হোক। দ্বিতীয়ত, জেলার যেখানে সেচ ব্যবস্থা যা অচল হয়ে রয়েছে তা দ্রুত সংস্কার করা হোক। তাহলে রবি মরসুমে অন্তত চাষিরা সেচের সেই সুবিধা পাবেন। তৃতীয়ত কম সেচে যে সমস্ত শস্য রবি চাষে হতে পারে সেই শস্যেরই বীজ চাষিদের দেওয়া হোক। চতুর্থত চাষিদের বীজ, সার, কীটনাশক যাই দেওয়া হোক তা যেন সময়মতো সরবরাহ করা হয়। একই সঙ্গে আগামী খরিফ মরসুমে চাষিদের যাতে নিখরচায় আমনের বীজ দেওয়া হয়, সেই প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এও জানানো হয়েছে, বিশ্বব্যাঙ্কের সহায়তায় জেলার চারটি ব্লকে যে ক্ষুদ্র সেচের কাজ চলছে তা যেন সবক’টি ব্লকেই চালু করা হোক। জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘জেলা জুড়ে অনাবৃষ্টিজনিত কারণে খরা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাই চাষিদের উপকারের জন্য আমরা কয়েক দফা প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠিয়েছি।’’
চাষিরাও জানিয়েছেন, সরকার বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি পাঠালে তা যেন পঞ্চায়েতের গুদামে জমা পড়ে না থাকে তা প্রশাসনকে দেখতে হবে। তাই বিলি করার সময় ও পরিমাণ প্রতিটি গ্রাম সংসদ এলাকায় ভাল করে প্রচার করতে হবে। তা না হলে চাষি বঞ্চিত হবে উল্টে ওই সব সরঞ্জাম চোরাপথে বিক্রি করে দুষ্টচক্র ফায়দা লুটবে। তবে তেমনটা হবে না বলেই আশ্বাস দিয়েছেন প্রশাসনের আধিকারিকরা। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া চাষিরা না আঁচিয়ে বিশ্বাস করতে রাজি নন।