বোলপুর পারলেও সাধ্যে কুলোল না আলিপুরের

বোলপুর যেটুকু সাহস দেখাতে পেরেছিল, আলিপুর তা-ও পারল না! খাস থানার ভিতরে নিজেরা আক্রান্ত হয়েও প্রকৃত হামলাকারী বা নেপথ্যের কুশীলব, কারও বিরুদ্ধে আঙুল তুুলল না আলিপুর থানার পুলিশ। চক্রান্তের পুরোভাগে থাকা ‘রাঘব-বোয়ালদের’ আড়াল করার এ হেন চেষ্টা দেখে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন তো উঠেইছে, উপরওয়ালাদের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ দেখে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে পুলিশবাহিনীরও নিচুতলায়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫৩
Share:

বোলপুর যেটুকু সাহস দেখাতে পেরেছিল, আলিপুর তা-ও পারল না! খাস থানার ভিতরে নিজেরা আক্রান্ত হয়েও প্রকৃত হামলাকারী বা নেপথ্যের কুশীলব, কারও বিরুদ্ধে আঙুল তুুলল না আলিপুর থানার পুলিশ। চক্রান্তের পুরোভাগে থাকা ‘রাঘব-বোয়ালদের’ আড়াল করার এ হেন চেষ্টা দেখে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন তো উঠেইছে, উপরওয়ালাদের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ দেখে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে পুলিশবাহিনীরও নিচুতলায়।

Advertisement

গত ৩ সেপ্টেম্বর রাতে দলবল নিয়ে বোলপুর থানায় চড়াও হয়েছিলেন বীরভূম জেলা যুব তৃণমূলের তদানীন্তন সভাপতি সুদীপ্ত ঘোষ। অভিযোগ, মত্ত অবস্থায় তিনি কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের ধমকি দেন, এমনকী তাঁদের গায়ে হাত তুলতেও কসুর করেননি। ঘটনায় শাসকদলের নেতা জড়িত থাকায় গোড়ার দিকে জেলা পুলিশের কর্তারা হাত গুটিয়ে থাকলেও পরে বাহিনীর অন্দরে ধূমায়িত ক্ষোভের আঁচ পেয়ে নড়েচড়ে বসেন। আদালতে পুলিশের পেশ করা কেস ডায়েরিতে সুদীপ্তের নাম উল্লেখ করা হয়। কেস-ডায়েরিতে দেওয়া হামলার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণের ভিত্তিতে সিউড়ি জেলা কোর্টের ভারপ্রাপ্ত বিচারক সুদীপ্তের আগাম জামিনের আবেদন খারিজ করে দেন।

সুদীপ্ত ঘোষ অবশ্য এখনও অধরা। কিন্তু তাঁর দিকে অন্তত অভিযোগের আঙুল তোলার মতো সাহস বোলপুরের পুলিশ দেখাতে পেরেছে। অথচ খাস মহানগরের আইনরক্ষকদের বুকে সেটুকু পাটাও দেখা যায়নি। শুক্রবার তৃণমূল সমর্থকদের তাণ্ডবের পরে ‘প্রকৃত’ হামলাকারী বা তাদের পিছনে থাকা নেতাদের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ রুজু করেনি আলিপুর থানা। বরং যে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে কোর্টে তুলেছে, তাঁদের কেউ এলাকার লোক নন। হামলার সময়ে তাঁরা আদৌ ঘটনাস্থলে ছিলেন কি না, সে সংশয় যথেষ্ট। উপরন্তু ওঁঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ যে ভাবে কেস সাজিয়েছে, তার ‘লঘুত্ব’ দেখেও আইনজীবী মহল যারপরনাই বিস্মিত।

Advertisement

বস্তুত আলিপুর-কাণ্ডে পুলিশি কেস-ডায়েরির নমুনা দেখে শনিবার স্বয়ং বিচারক পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কী রকম?

পাঁচ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পুলিশের আনা অভিযোগ খতিয়ে দেখে আলিপুর পুলিশ কোর্টের মুখ্য বিচারক সঞ্জীব দারুকা সরকারি কৌঁসুলির কাছে জানতে চান, “আপনারা যে অভিযোগ এনেছেন, তাতে তো এমপিও (স্বাভাবিক জনজীবন অক্ষুণ্ণ রাখা) আইনের ৯ নম্বর ধারা আর পিডিপিপি (সরকারি সম্পত্তি রক্ষা) আইনের ৩ নম্বর ধারা প্রয়োগ করা উচিত ছিল! আপনারা করেননি!” সরকারি কৌঁসুলি কিছু একটা ব্যাখ্যা দিতে গিয়েছিলেন। আমল না-দিয়ে বিচারকের মন্তব্য, “ওই দু’টো ধারা কেন দিলেন না, ভেবে অবাক লাগছে।”

প্রসঙ্গত, ধৃত পাঁচ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা রুজু করেছে ভারতীয় দণ্ডবিধির পাঁচটি ধারায় ১৪৩, (অবৈধ জমায়েত), ১৪৭ (গণ্ডগোল পাকানো), ১৪৯ (অপরাধ সংগঠনের উদ্দেশ্যে জমায়েত), ৩৫৩ (সরকারি কর্মীর উপরে আক্রমণ) এবং ২৮৩ (জবরদস্তি রাস্তায় বাধা সৃষ্টি)। এতে দোষী সাবস্ত হলে সর্বোচ্চ দু’বছরের কারাবাস হতে পারে। কিন্তু এমপিও-র ৯ নম্বর এবং পিডিপিপি-র ৩ নম্বরে অপরাধী প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ যথাক্রমে দশ বছর ও পাঁচ বছরের সাজার বিধান রয়েছে।

এমতাবস্থায় ওই দু’টি বাদ দিয়ে এমন ‘হাল্কা’ ধারা প্রয়োগের পিছনে অন্য ‘অঙ্ক’ দেখছেন অনেক আইনজীবী। তাঁদের মতে, পুলিশের তরফে ধৃতদের হেফাজতে না-চাওয়াটাও বিশেষ সেই পরিকল্পনার অঙ্গ, ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই এই পদক্ষেপ। “চাপের মুখে ঘটনার কুশীলবেরা গ্রেফতার হলেও যাতে কড়া শাস্তি না হয়, এবং সরকারি জেল হেফাজতে পাঠানো যায়, সে দু’টো রাস্তা এ ভাবেই খুলে রাখল পুলিশ।” অভিমত এক আইনজীবীর। তাঁর পর্যবেক্ষণ, “শাসকদলের লোকেদের রক্ষা করার তাগিদ যেখানে প্রবল, সেই পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষে এমপিও বা পিডিপিপি প্রয়োগের কথা ভাবাই কঠিন।”

পরিণামে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গিয়েছে আসল মাথারা। আলিপুর থানার পুলিশকর্মীরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। কিন্তু যে ভাবে বড়কর্তাদের নির্দেশে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তুলনায় লঘু নালিশ দায়ের হয়েছে এবং আসল দোষীদের আড়াল করা হচ্ছে, তাতে ঘনিষ্ঠ মহলে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তাঁদের একাংশ। সুর মিলিয়েছেন অন্যান্য থানায় কর্মরত সহকর্মীরা। এমপিও-পিডিপিপি’তে মামলা হল না কেন? কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র রবিবার বলেন, “বিচারকের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আমরা দেখছি, ওই ধারা প্রয়োগ করা যায় কি না।”

আম-পুলিশকর্মীদের অনেকে যদিও যুক্তিটি মানতে পারছেন না। “যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রের বেলায় পুলিশ কি সব দিক খতিয়ে দেখে তাঁকে গ্রেফতার করেছিল?” প্রশ্ন তুলছেন ওঁরা। ওঁদের আশঙ্কা, লালবাজারের নিষ্ক্রিয়তায় শেষমেশ নিস্তারই পেয়ে যাবে আলিপুর-কাণ্ডের রথী-মহারথীরা। আদালত চাইলে পুলিশকে সক্রিয় করতে পারে, এমপিও বা পিডিপিপি’তে মামলা করার জন্য নির্দেশ দিতে পারে পুলিশকে। মুম্বই হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “বিচারক নিজে থেকে পুলিশকে ওই আইনের ধারা জুড়তে বলতে পারেন। সে অবকাশ রয়েছে।”

এখন প্রশ্ন, পুলিশ কি ইচ্ছাকৃত ভাবে ‘ভুল’ করল? সাম্প্রতিক নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে সংশয়টা স্বাভাবিক। বিভিন্ন মামলায় পুলিশ যে ভাবে এফআইআর লিখেছে, এবং আদালতে পরোক্ষে অভিযুক্তদের ‘পক্ষ’ নিয়েছে, তা দেখে নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে হাইকোর্টও তাদের ভর্ৎসনা করেছে। ক’দিন আগে এক মামলায় পুলিশের কাগজপত্র দেখে হাইকোর্ট কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে ডেকে পাঠিয়েছিল! পাড়ুই-মামলার এফআইআরে বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের নাম কেন নেই, খোদ রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে আদালতে দাঁড়িয়ে তার জবাবদিহি করতে হয়েছে! একাধিক মামলায় বিচারপতিরা প্রশ্ন তুলেছেন, এ রাজ্যের পুলিশ কি কার্যত শাসকদলের অঙ্গুলিহেলনে চলছে?

আলিপুর-কাণ্ড ফের খুঁচিয়ে তুলেছে সেই প্রশ্ন। যে প্রসঙ্গে নিচুতলার পুলিশকর্মীদের একান্ত আলাপচারিতায় ঘুরে-ফিরে আসছে বোলপুর-কাণ্ডের কথা। ঘনিষ্ঠ মহলে আলিপুর থানার এক পুলিশকর্মীর আক্ষেপ, “সুদীপ্ত ঘোষ গ্রেফতার হয়নি ঠিকই। কিন্তু বোলপুর থানার আইও কোর্টে যে কাগজ জমা দিয়েছেন, তাতে পুলিশের মুখ কিছুটা বেঁচেছে। এখানকার পুলিশ সেটুকুও করে উঠতে পারল না!” পুলিশ-সূত্রের খবর: ঘটনার পরে সুদীপ্তকে ‘ভাল ছেলে’ বলে অনুব্রত দাবি করেছিলেন, সে নির্দোষ। তা সত্ত্বেও বোলপুর থানা সুদীপ্তের দিক থেকে আঙুল হঠায়নি, যে কারণে আদালত ওই যুব নেতার আগাম জামিন খারিজ করেছে।

কিন্তু আলিপুরে উল্টোটা দেখা যাচ্ছে। নিচুতলার পুলিশকর্মীদের পর্যবেক্ষণ বলছে, রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম শুক্রবারের হামলাকে ‘সামান্য ঘটনা’ হিসেবে দেগে দেওয়ার পরেই লালবাজার গুটিয়ে গিয়েছে। “মন্ত্রী যেখানে বলে দিচ্ছেন কিছুই হয়নি, সেখানে পুলিশ কী বলবে?” কটাক্ষ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। থানায় থানায় সাধারণ পুলিশকর্মীরা প্রমাদ গুনছেন। আলিপুর থানার এক পুলিশকর্মীর প্রশ্ন, অপরাধ করেও যখন পার পাওয়া যাচ্ছে, তখন যে কোনও ছুতোয় আবার থানায় হামলা হবে না, তার গ্যারান্টি কী?

“তখন হয়তো ফের আমাদের কোনও সহকর্মীকে জান-মান বাঁচাতে টেবিলের তলায় ঢুকতে হবে!” বলছেন তিনি।

আপাতত শান্তি


ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

শাসক দলের নেতার ‘প্রতাপ’ কমতেই রবিবার বিধানচন্দ্র রায় কলোনি থেকে সরে গেল পুলিশ পিকেট। বাসিন্দারাও জানিয়ে দিলেন, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখন শান্তি চান তাঁরা। শনিবারই রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের ঘনিষ্ঠ এবং কলোনি কমিটির সভাপতি প্রতাপ রায় খানিকটা পিছু হটে জানিয়ে দিয়েছিলেন, থানায় হামলা চালানো ঠিক হয়নি। এ দিন তাঁর সুরেই বাসিন্দাদের অনেকেই বলেন, “ওই ঘটনায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। অফিসের সহকর্মীদের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না। এখন আর এ সব নিয়ে তাই আমরা আর আলোচনা চাই না। এখন শান্তি চাই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন