মহলার মুহূর্তে। ছবি: সুব্রত জানা।
বায়োপিক নয়। তবে এরই একটা গ্রাম্য সংস্করণ বটে।
হাওড়ার বাগনান-শ্যামপুর রোডের পাশেই দেওড়া। সেখান থেকে প্রায় ছ’কিলোমিটার গেলে পড়বে রতনপুর গ্রাম। কৃষিজীবী অধ্যুষিত এই গ্রামেরই সন্তান ছিলেন জলধর বাগ। তিনি ছিলেন কালিপাতাড়ি শিল্পী। হাওড়া জেলার অন্যতম প্রধান লোক সংস্কৃতি এই কালিপাতাড়ি নাচ। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে জলধর মারা যান এ বছরের ১৩ জুলাই। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৫২। রতনপুর এবং তার পাশের গ্রাম আমড়দহের মানুষদের নিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন নাচের দল। সেই স্মৃতি এই গ্রামের মানুষের বড় সম্পদ। তাই জলধরকে ফিরিয়ে আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন এই দুই গ্রামের মানুষজন। তাঁর জীবন নিয়ে লেখা হয়েছে নাটক ‘রতনপুরের রাত্রিদিন’। এই নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ২৬ ডিসেম্বর উলুবেড়িয়ার রবীন্দ্রভবনে। ওই দিন যেন পুনরাবির্ভাব ঘটবে জলধরের। সেই পরিকল্পনাকে সফল করতে দিন রাত এক করে ফেলেছে রতনপুর ও আমড়দহ।
যাঁরা অভিনয় করছেন, তাঁরা কালিপাতাড়ি নাচ করলেও আধুনিক নাটক কোনওদিন করেননি। কিন্তু তাতে কী! গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে এটাকেই সেরা পথ হিসাবে বিবেচনা করেছেন তাঁরা।
কালিকাপাতাড়ি হল হাওড়ার নিজস্ব লোকসংস্কৃতি। পুরাণ ও মহাকাব্যের ভিত্তিতে মুখে মুখে রচিত হয় এক একটি টুকরো কাহিনি। বাদ্যযন্ত্র সহকারে এই কাহিনিগুলিই অভিনীত হয়। তার সঙ্গে চলে শিল্পীদের উদ্দাম নাচ। কালিপাতাড়ির সঙ্গে তুলনীয় পুরুলিয়ার ছৌ নাচ। কালিপাতাড়ির নাটকগুলি পুরাণ এবং মহাকাব্যের এমন সব অংশ থেকে নেওয়া যেগুলিতে শক্তির প্রদর্শনী করা যায়। শুম্ভ-নিশুম্ভ, মহিষাসুর বধ এই সব পালাই বেশি করে অভিনীত হয়। বিশালদেহী, বাবরি চুলের জলধর ছিলেন তাঁর দলের এক বিশিষ্ট শিল্পী। প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করতেন তিনি নিজেই। মহিষাসুর বধ পালায় তিনি সাজতেন মহিষাসুর।
এক ছেলে তিন মেয়ে দুই জামাই এবং স্ত্রী এই নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। ছোট বাড়ির এক চিলতে দাওয়া ছিল তাঁর মহড়ার জায়গা। গ্রামের মানুষকে জুটিয়ে নিয়ে তিনিই গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব রতনপুর রত্নমালা কালিকাপাতাড়ি নৃত্য সংস্থা। শেষ তিন বছর তিনি ভুগছিলেন ক্যান্সারে। তবুও দল টিকিয়ে রেখেছিলেন সন্তানের মতো করে। প্রতি বছর দেবী রত্নমালার মন্দিরে নীলরাত্রির দিনে অনুষ্ঠিত হত কালিকাপাতাড়ির নাচ। তার পরে জেলা ও রাজ্য জুড়ে তাঁর সংস্থা অনুষ্ঠান করে বেড়াতো। রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের স্বীকৃত এই শিল্পী ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পরে নাচতে পারতেন না। কিন্তু দলের বাজনদারদের সঙ্গে বসে ক্যাসিও বাজাতেন।
জলধরের সেই উদ্দাম নাচ, বাঁশি ও ক্যাসিও বাজানো অবিকল দেখা যাবে রবীন্দ্রভবনে। সিনেমায় যেমন বায়োপিক, নিতান্ত ছোট পরিসরে যেন বায়োপিকেরই একটা ছোট সংস্করণ এই রতনপুরের রাত্রিদিন। এতে যেমন আছে জলধরের সংসার, তেমনই আছে রত্নমালার মন্দির, নীলরাত্রি। এই নাটকের কোনও চরিত্রই কাল্পনিক নয়।
মোট ৪০টি চরিত্র আছে এই নাটকে। ৩৩ জন পুরুষ ও ৭ জন মহিলা। জলধরের স্ত্রীর চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, সেই আরমিনা খাতুন ছাড়া বাকিদের আধুনিক নাটক করার কোনও অভিজ্ঞতাই নেই।
লালমোহন ঘোষ, বিকাশ জানা, সিদ্ধেশ্বর দোরার মতো মানুষজন এই নাটকে অভিনয় করছেন। সকলেই পেশায় চাষি। অভিজ্ঞতা বলতে কালিকাপাতাড়ির নাচে অংশগ্রহণ। চড়াদাগের এই নাটকের সঙ্গে আধুনিক নাটকের সূক্ষ্ম অভিনয়ের কোনও তুলনাই চলে না। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন তাঁরা। চাষবাসের কাজ সেরে সন্ধ্যার পরে আমড়দহের সিদ্ধেশ্বর দোরার বাড়িতে প্রতিদিন বসে মহড়া। টানা তিন মাস ধরে চলছে এই মহড়া। এই নাটকে অভিনয় করছেন জলধরের ছেলে পাপাই এবং ভাইঝি কৃষ্ণাও।
নাটকের পরিকল্পনাটি অবশ্য করেন উলুবেড়িয়ার শ্যামল দত্ত। নাট্যপ্রেমী এই মানুষটি প্রতি বছর রবীন্দ্রভবনে নাট্যোৎসব করেন। কলকাতার বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্বরা হাজির থাকেন। সেই উৎসবই অনুষ্ঠিত হবে এ বছর রবীন্দ্রভবনে। শ্যামলবাবুই এই নাটক লিখেছেন। মহড়া চলছে তাঁরই অধীনে। তিনি বলেন, ‘‘কালিকাপাতাড়ি নিয়ে আমি কিছু কাজ করেছি। জলধর মারা যাওয়ার পরে তাঁকে নিয়ে নাটক লিখি। তা অভিনয় করার জন্য তাঁর দলের সদস্যদের কাছে প্রস্তাব দিই। তাঁরা রাজি হয়েছেন।’’ লালমোহনবাবু বিকাশবাবুরা বলেন, ‘‘আমাদের গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের এটাই সেরা রাস্তা বলে আমাদের মনে হয়েছে।’’
প্রত্যন্ত গ্রাম আমড়দহ সন্ধ্যার পরে যখন নিঝুম হয়ে যায়, সিদ্ধেশ্বর দোরার বাড়ি তখন জেগে ওঠে। ঢোল, তাসা, কাঁসর, বাঁশি, ক্যাসিও বেজে ওঠে সম্মীলিতভাবে। উদ্দাম নাচে মেতে ওঠে মহিষাসুর, ওরফে জলধর, ওরফে তাঁর ভূমিকায় অভিনয় করা বিকাশ জানা। এই নাচ যত নিখুঁত হয় তৃপ্ত হয় বিকাশের চোখ। তাঁর মধ্যে থেকেই যে প্রাণ পাচ্ছেন গ্রামের স্মৃতি আলোয় ভরে রাখা প্রয়াত এক শিল্পী।