অসহিষ্ণুতা নিয়ে সংসদে বিতর্কে তাঁরা যতই পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানান, পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন বিধানসভা ভোটের আগে যতই উত্তপ্ত হয়ে উঠুক সমীকরণ— একটি বিষয়ে এখন সিপিএম, তৃণমূল, কংগ্রেস, বিজেপির সাংসদ-নেতারা এককাট্টা। তা হল, বিশ্বভারতীর উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্তের অপসারণ।
রাষ্ট্রপতি তথা বিশ্বভারতীর ‘ভিজিটর’ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে ইতিমধ্যেই দু’বার সুশান্তবাবুকে বরখাস্ত করার আর্জি জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। কিন্তু গত দু’মাসের মধ্যে দু’বার সেই ফাইল মন্ত্রকে ফেরত পাঠিয়েছেন প্রণববাবু। সূত্রের খবর, এই প্রক্রিয়া যদি আরও বিলম্বিত হয়, সে ক্ষেত্রে সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি পাঠিয়ে দরবার করার ভাবনা রয়েছে চার দলেরই।
আর্থিক গরমিল ও প্রশাসনিক অব্যবস্থার একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে গত জুন মাসে সুশান্তবাবুকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়। তাঁর জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে সুশান্তবাবুকে বরখাস্তের সুপারিশ করে মন্ত্রক। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে ই-মেলে ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দেন সুশান্তবাবু। রাষ্ট্রপতির সচিবালয় তা পাঠায় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকে। কিন্তু সূত্রের বক্তব্য, সুশান্তবাবুকে নিজে থেকে সরে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে তাঁকে বরখাস্ত করেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে চায় মন্ত্রক।
সেই মর্মেই সুপারিশ করা হয়েছিল রাষ্ট্রপতির কাছে। সুশান্তবাবুর পাল্টা দাবি ছিল, তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ দেওয়া হয়নি। গত সেপ্টেম্বরে প্রথম বার ফাইল ফেরত পাঠিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবন জানতে চায়, এই ভাবে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত আইনি ভাবে কতটা বৈধ। এর পর অ্যাটর্নি জেনারেল এবং আইন মন্ত্রকের সুপারিশ রিপোর্টের সঙ্গে যুক্ত করে ফের রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। গত সপ্তাহে আরও কিছু আইনি ও পদ্ধতিগত ব্যাখ্যা চেয়ে সেই ফাইল আবার ফেরত পাঠানো হয়েছে।
সংবিধান মোতাবেক, দু’বারের পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের পাঠানো কোনও ফাইল রাষ্ট্রপতি আর ফেরত পাঠাতে পারেন না। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দলের নেতারা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে আর বেশি দেরি হোক, তাঁরা চান না। তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায় থেকে ‘নবীন’ অনুপম হাজরা, সিপিএমের ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজেপির সুরিন্দর সিংহ অহলুওয়ালিয়া, কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্য— প্রত্যেকেই এ বিষয়ে একমত। কারও কারও সন্দেহ, সুশান্তবাবুকে ঘিরে হয়তো কমবেশি তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে সব দলের নেতাদেরই। সম্ভবত সেই কারণেই তাঁরা এমন এককাট্টা। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাননি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তৃণমূল সূত্রের খবর, তিনিও চাইছেন দ্রুত এই উপাচার্যের অপসারণ হোক। বোলপুরের তৃণমূল সাংসদ অনুপমের ক্ষোভ, তাঁর ‘বিশেষ ছুটি’র মেয়াদ শেষ হওয়ায় বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ তাঁকে শিক্ষক পদ থেকেই সরিয়ে দিয়েছিলেন। গত জুন মাসে অনুপমকে নিয়ে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন সৌগতবাবু। দমদমের অধ্যাপক-সাংসদের কথায়, ‘‘স্মৃতি আমাদের জানিয়েছেন কাজটা বেআইনি হয়েছে। তাঁর নির্দেশে এই ভুল সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য মন্ত্রকের যুগ্মসচিব চিঠিও দেন উপাচার্যকে। সেই চিঠি পাঠানোর পরেও সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেননি তিনি।’’
মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক সূত্রে বক্তব্য, সুশান্তবাবুর ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, নেওয়া হয়েছে। অপেক্ষা হচ্ছে শুধু রাষ্ট্রপতি ভবনের সবুজ সংকেতের জন্য। স্মৃতির মতে, তাঁদের এই সিদ্ধান্ত কোনও ভাবেই শিক্ষাক্ষেত্রে ‘ব্যক্তিগত’ হস্তক্ষেপ নয়। বিশ্বভারতীর কর্মী সংগঠনের অভিযোগের ভিত্তিতেই পদক্ষেপ করা হয়েছে। তাঁর কাছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের বেশ কিছু লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ এসেছিল। যার ভিত্তিতে ইলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বি বি দত্তের নেতৃত্বাধীন ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা হয়েছে।
বিশ্বভারতীর ‘গরিমা হানি’র অভিযোগ তুলে গত কালও রাজ্যসভায় উপাচার্যের ইস্তফার দাবিতে সরব হয়েছিলেন কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য। ইতিমধ্যেই স্মৃতির কাছে লিখিত অভিযোগে তিনি বলেছেন, ‘‘বিশ্বভারতীর কাজকর্ম একজন স্বেচ্ছাচারীর মতো পরিচালনা করছেন সুশান্তবাবু। উপাচার্যকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য যে অধ্যাপক-সভা রয়েছে, তার পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছেন না তিনি। নিয়মের বাইরে গিয়ে ‘কন্ট্রোলার অব এগজামিনেশন’ নামে একটি পদ সৃষ্টি করেছেন তিনি। তার জন্য ইউজিসি বা মন্ত্রকের কোনও অনুমতি নেননি।’ বিশ্বভারতী আইন ১৯৫১ অনুযায়ী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রোভোস্ট’ বলে কোনও পদ নেই। অভিযোগ, তার পরেও ৫ জনকে এই পদে বসিয়েছেন সুশান্তবাবু। বেআইনি ভাবে পদ সৃষ্টি ছাড়াও সুশান্তবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকায় নিয়োগে স্বজনপোষণ থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য— সবই রয়েছে। যৌন হেনস্থার অভিযোগও উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে বিশ্বভারতীর বেতন ও আগের চাকরির পেনশন নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
এই প্রসঙ্গে সুশান্তবাবুর দাবি, সব অভিযোগই অসত্য। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আইআইএসইআর-এর অধ্যক্ষ
পদে থাকার সময় আমি যা বেতন পেতাম, বিশ্বভারতীতে ঠিক সেটাই পাই।’’ নতুন পদ তৈরির প্রশ্নে তাঁর সওয়াল, ‘‘নতুন কোনও পদ তৈরি করা হয়নি। তিন জন প্রবীণ অধ্যাপককে বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, উপাচার্য চাইলে কোনও অধ্যাপককে বাড়তি দায়িত্ব দিতে পারেন।’’